Reading Time: 4 minutes

সামুদ্রিক ও মিঠা পানির মাছের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামে। মাছের পাইকারি বাজার বা ফিশারি ঘাট হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় ২০০ বছর আগে। আর এর গোড়াপত্তন হয় পর্তুগিজদের হাতে। চট্টগ্রামে ব্যবসায়ের প্রয়োজনে তাদের আনাগোনা যখন শুরু হয় এবং বন্দরের শুল্ক আদায়ের অধিকার পেয়ে যাওয়ার পরই এই আড়ত স্থাপন করা হয়। 

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ফিশারি ঘাট এর অবস্থান দুইটি জায়গাতে রয়েছে। পাথরঘাটার ইকবাল রোডের ফিশারি ঘাটের অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে এখন নতুন করে এবং আরও বড় পরিসরে ফিশারি ঘাটটি বানানো হয়েছে কর্ণফুলী নদীর তীরে রাজাখালীর মুখে লুসাই কন্যাতে। যেখানে প্রতি রাতে ৩টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত  মৌসুমভেদে বিভিন্ন ধরনের মাছের কেনাবেচা চলে। এই ঘাটে মূলত দেশের প্রতিটি জেলা থেকেই মাছ আসে, যা পরবর্তীতে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যায়। আর তাই মাছের আড়তদারদের ভিড়ে রীতিমত সরগরম থাকে চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাট। চলে কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা।  

ঘাট পরিচালনা 

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ফিশারি ঘাট
তাজা মাছের খোঁজে সরগরম ফিশারি ঘাট

ফিশারি ঘাটের তীরে মাছ বোঝাই ট্রলার এসে পৌঁছালেই শুরু হয়ে যায় হাঁকডাক। অতঃপর এক এক করে মাছের টুকরি, প্লাস্টিকের বড় চৌবাচ্চা করে নামানো হয় মাছ। ঘাট ঘিরে এসময় এতটাই ব্যস্ততা থাকে যে এ সময় যেন কারো অন্য কোন দিকে তাকানোর সময়ও থাকে না। দরকষাকষি, মাছের নাম নিয়ে হাঁকডাক এবং ঝুড়ি ভরে মাছ এক ট্রাক থেকে আরেক ট্রাকে তোলার হুড়াহুড়ি চলে। 

চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাট থেকে পাইকারি দামে মাছ সরবরাহ হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সারা দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা এই বাজারে আসেন। তবে শুধু দেশেই নয়, এই ঘাট থেকে দেশের বাইরেও মাছ রপ্তানি করা হয়। অনেক মাছ ব্যবসায়ী এই ঘাটের আড়তদারদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন প্রজাতির তাজা এই মাছগুলোকে অহরহই বিদেশে রপ্তানি করে যাচ্ছেন।

দেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও, মিয়ানমার ও ভারত থেকেও চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাটে মাছ আসে। সামুদ্রিক ও মিঠা পানির তাজা মাছের এ যেন এক বিশাল সম্ভার। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর নগরীর খুচরা বিক্রেতারাও এই ঘাট থেকে সামুদ্রিক মাছ কিনে তা বিভিন্ন এলাকার বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন। যেখান থেকে মাছ প্রেমীরা তাদের পছন্দের মাছ কিনতে পারেন।   

এই ঘাটে মোট চারটি জেটি রয়েছে। এর মধ্যে একটি পরিচালনা করছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। বাকি তিনটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) লিজ দিয়েছে। মাছ আনা নেয়ার এই ট্রলারগুলোকে প্রতি ট্রিপে ২০০ টাকা এবং বিক্রি হওয়া মাছের ২ শতাংশ দিতে হয় চউককে। 

বাহারী মাছের সমাহার

আড়তে ঝুড়ি ভর্তি মাছ
সামুদ্রিক মাছে ভরপুর চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাট

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে রাজাখালীর এই ফিশারি ঘাটে বর্তমানে আড়ত রয়েছে প্রায় ২২০টি। তবে পুরনো ফিশারি ঘাটে রয়েছে ৬৮টি আড়ত। কেননা পুরনো বাজারের বেশিরভাগই এখন নতুন বাজারে আড়ত নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। আর তাই এমন কোনো মাছ নেই যা নতুন এই আড়তে পাওয়া যায় না। 

সামুদ্রিক মাছের মধ্যে লাক্ষা, ইলিশ, কই, কোরাল, দাতিনা কোরাল, রেড স্নাপার, ভেটকি, সুরমা, কাটল ফিশ, তাইলন্ডা, মাইট্টা, চেউয়া, দেশি স্কুইড, রূপচাঁদা, ম্যাকারে, চিংড়ি, টুনা, স্যামন, ম্যাকরেল, সারডিন, লবস্টার, টুনা কড, ছুরি, পোপা, ফাইস্যা, লইট্যা ইত্যাদি সব ধরনের মাছই চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাট এ পাওয়া যায়। সামুদ্রিক মাছ ছাড়াও দেশীয় সব প্রজাতির চিংড়ি, চাপা, চাপিলা মাছও আসে এই ঘাটে। অন্যদিকে মিঠা পানির মাছের মধ্যে পুকুর-খামার থেকে সংগ্রহ করা রুই, কাতলা, বোয়াল, কই, মাগুর, শিং, তেলাপিয়া, কাচকি, বাইলা, বাইম, মইল্লা, পুঁটি মাছও পাওয়া যায় এই ফিশারি ঘাটে। 

এত ধরনের মাছ যেখানে পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে শৌখিন মাছ ক্রেতারা আসবেন না, তা কি হয়! পাইকারী ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সাধারণ ক্রেতারাও প্রতিদিন ভোরে হাজির হয়ে যান এই ফিশারি ঘাটে তাজা মাছের খোঁজে। 

জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম 

মাছ ধরার জাল মেরামত
চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাটে চলছে জাল মেরামতের কাজ

ভোরের আলো দেখা দেয়ার সাথে সাথে যেন হঠাৎ করেই এ জায়গার চিত্র পাল্টে যায়। মাছশ্রমিক, মুটে, চাওয়ালা, পানওয়ালা এবং বাজারের ব্যাগওয়ালা অনেকেরই কর্মস্থল চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাট। এছাড়া জাল মেরামত করার জন্য এই ঘাটে প্রতিদিন বেশ কিছু মানুষ কাজ করে। যাদের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যমই এই ফিশারি ঘাট। এই বাজারকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে কোল্ড স্টোরেজ, যেখানে মাছ স্টোর করে রাখা হয়। এছাড়া ঘাটে খাবারের হোটেলও আছে বেশ কয়েকটি। এই ফিশারি ঘাট ঘিরেই প্রায় অর্ধলাখ মানুষের জীবিকা জড়িয়ে আছে। চট্টগ্রামের প্রায় ১০ হাজার ফিশিং বোট ও কয়েকশ ট্রলারের মাছ বিক্রি হয় এই বাজারে। 

ইলিশের মৌসুমে ফিশারি ঘাট 

ইলিশ মাছের আড়ত
ইলিশের মৌসুমে চলছে মাছ কেনাবেচার ব্যস্ততা

নির্দিষ্ট কিছু মৌসুমে এই ঘাটে এতটাই ব্যস্ততা বেড়ে যায়, যেন নিঃশ্বাস নেয়ারই সময় থাকে না। এর মধ্যে বিশেষ হচ্ছে ইলিশ ধরার মৌসুম। আগস্ট থেকে অক্টোবরের সময়টা ইলিশ ধরার মৌসুম বলে বছরের এ সময় বেশি পরিমাণে মাছের কেনাবেচা হয় এই আড়তগুলোতে। 

ইলিশ মাছের অন্যতম বড় আড়ত হিসেবে এই ফিশারি ঘাট বেশ জনপ্রিয়। ঘাটে ছোট, মাঝারি এবং বড় এই তিন ধরনের ট্রাকে করে ইলিশ মাছ আনা হয় এবং বেপারীরা নিলামে ডাকেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দাম যিনি বলেন তিনি মাছ ভর্তি সেই ট্রাকের মালিক হয়ে যান এবং ৩০-৩৫ মণ ওজনের মাছের এই ট্রাকগুলো পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন বাজারে নিয়ে যান। 

মাছ তাজা রাখতে এই ঘাটে বরফের প্রয়োজন পড়ে। ২০ থেকে ২৫ কেজি ওজনের একেকটি বরফের টুকরা এখানে ৬০০-৭০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। তবে মাছের দাম যদি বেড়ে যায় সেক্ষেত্রে বরফের দামও বৃদ্ধি পায়। মাছ কেনাবেচার পাশাপাশি এই ঘাটে মাছ কেটে দেয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। সমুদ্রের এবং মিঠা পানির তরতাজা মাছের জন্য বাংলাদেশে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ফিশারি ঘাট তাই বহুল পরিচিত।    

কমপ্লিট প্রপার্টি সল্যুশন খুঁজছেন? এখনই ডাউনলোড করুন বিপ্রপার্টি অ্যাপ 

For Android:  www.tinyurl.com/bpropertyapp  

For iOS: www.tinyurl.com/57kj4dnw 

Write A Comment

Author