Reading Time: 4 minutes

ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান ২০১৬ – ২০৩৫ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগে, চলুন এই প্রজেক্ট শুরুর পেছনের ইতিহাস বা এর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছুটা জেনে আসা যাক। ঢাকাকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং একটি সুন্দর শহরে রূপান্তরের লক্ষ্যে ১৯৫৮ সালের দিকে প্রথম এই পরিকল্পনাটি করা হয়। সেসময় এই প্রজেক্টের নাম দেয়া হয়েছিল ‘ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) মাস্টার প্ল্যান। তবে দুঃখের বিষয় হলো, ২০ বছরেও এই পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের দিকে, তৎকালীন সরকার ঢাকাকে একটি পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আরেকটি উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং ‘প্রিপারেশন অফ স্ট্রাকচার প্ল্যান, মাস্টার প্ল্যান এবং ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান ফর ঢাকা” নামে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়। 

অবশেষে, ১৯৯৫ সালের দিকে বাংলাদেশ সরকার ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান বা ডিএমডিপি’ নামে ঢাকার জন্য প্রথমবারের মতো বেশ বড়সড় একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যা পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হয়।

এই প্রকল্পটি তিনটি বিভাগীয় উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা নিয়ে গঠিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে- স্ট্রাকচার প্ল্যান, মাস্টার প্ল্যান এবং ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান। যদিও কিছু আইনানুক বিভ্রান্তি এড়াতে ‘মাস্টার প্ল্যান’ নামটি পরিবর্তন করে উক্ত প্রকল্পের নাম রাখা হয় ‘আরবান এরিয়া প্ল্যান’। তবে বরাবরের মতো কোনো ধরনের বাস্তবায়ন ছাড়াই পরবর্তীতে এই প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। 

অতঃপর পরের বছর বিদ্যমান ডিএমডিপি (১৯৯৫-২০১৫) পর্যালোচনা করার জন্য এবং ২০১৬-২০৩৫ সালের জন্য পরিকল্পিত ঢাকা মেট্রোপলিটন অঞ্চলের ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান এবং আরবান এরিয়া প্ল্যান বাস্তবায়ন বিষয়ে কৌশলগত কিছু পরিকল্পনা প্রস্তুত করার জন্য পুনরায় একটি সংশোধিত প্রকল্পের প্রস্তাব দেয়া হয়।

তবে এসব কিছুর মধ্য থেকে আজ আমরা আলোচনা করবো ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান ২০১৬-২০৩৫ এর কিছু সম্ভাবনাময় দিক এবং এটি বাস্তবায়িত হলে এর থেকে আমরা কী কী সুবিধা পেতে পারি এ সংক্রান্ত কতিপয় বিষয় নিয়ে।

ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান ২০১৬-২০৩৫ থেকে কী আশা করা যেতে পারে? 

ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্যই হলো ঢাকাকে একটি বসবাসযোগ্য, কার্যকরী এবং স্থিতিস্থাপক মেগাসিটি হিসেবে গড়ে তোলা, যেখানে স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াবলী যেমন থাকবে, তেমনি শহরের পরিবেশগত দিক সঠিকভাবে বজায় রাখার বিষয়ও গুরুত্ব পাবে। ফলে, ঢাকার মানুষেরা শহরের বিভিন্ন ধরনের সেবা এবং সুযোগ-সুবিধাসমূহ যেমন খুব সহজে পেতে পারবে, তেমনি পরিবহন ব্যবস্থায়ও যথাযথ অগ্রগতি হবে বলেই আশা করা যাচ্ছে।   

বসবাসের ব্যবস্থা বৃদ্ধি 

ঢাকাকে বাসযোগ্য স্থানে রূপান্তরের লক্ষ্যে করা পরিকল্পনার অধীনে রয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন অঞ্চলের (ডিএমআর) মধ্যে  নগর উন্নয়ন এবং সুসংযুক্ত নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করে সামগ্রিকভাবে বসবাস যোগ্যতা বৃদ্ধি করা।

এছাড়া ঢাকার পুরনো বিভিন্ন স্থাপনা পুনর্নির্মাণ, পুনর্বাসন এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে ঢাকাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলাও এর অন্যতম লক্ষ্য। এর ফলে ঢাকার সাথে অন্যান্য অঞ্চলের সংযোগ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাও আরও উন্নত হবে বলেই আশা করা যাচ্ছে।    

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি 

মধ্যম ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে এ ধরনের পরিকল্পনা বেশ সহায়ক হবে। যা কিনা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উন্নত করতে সাহায্য করবে। এমনকি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ফলে উৎপাদনশীলতার হার যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি সাশ্রয়ী মূল্যে কর্মীদের এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যে যাতায়াতের প্রয়োজনীয় সেবা দেয়ার মতো বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগও এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে।

নাগরিকদের জন্য উন্নত সুবিধা নিশ্চিতকরণ 

ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল নাগরিকদের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে উন্নত সেবা প্রদান করা। অর্থাৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে, বন্যার ঝুঁকি হ্রাস করে তা বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে যেমন সহায়তা করবে, তেমনি শহুরে তাপমাত্রা কমিয়ে আনা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা এবং উন্মুক্ত জায়গার ব্যবস্থা করার মতো বিষয়গুলোও গুরুত্ব পাবে।

বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা, বর্জ্য উৎপাদন কমাতে থ্রিআর কৌশল চালু, নির্দিষ্ট এলাকা সমূহে পাবলিক টয়লেট স্থাপনের ব্যবস্থা ইত্যাদিও রয়েছে এই পরিকল্পনার আওতায়। এছাড়া ভবিষ্যতের জনসংখ্যার অনুপাতে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা প্রদান করার বিষয়টিও এখানে গুরুত্ব পাবে।

প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা

ঢাকা মেট্রোপলিটন অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে। তাছাড়া বিদ্যমান উন্মুক্ত স্থানগুলো যার বিশেষ এবং ঐতিহ্যগত সুনাম রয়েছে সে সকল স্থাপনা নতুন এই পরিবেশ সুরক্ষা নীতির অধীনে এনে সুরক্ষিত করার পরিকল্পনাও রয়েছে এই প্রকল্পে৷

এছাড়া জ্বালানি-দক্ষ এবং ঝুঁকি-সংবেদনশীল ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা তৈরির বিধানও প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমাতে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানে কার্যকর ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ETP) চালু করার কথাও রয়েছে।  অর্থাৎ, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলাই যায় যে, বর্তমান অবস্থা থেকে ঢাকা আরও টেকসই একটি শহর হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করবে ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান। 

কার্যকরী পরিবহন ব্যবস্থা চালু  

ঢাকা শহরে পরিবহন ব্যবস্থার অসুবিধা এবং যাতায়াতের সমস্যা বরাবরের মতোই একটি আলোচ্য বিষয়। আর এ ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ঢাকার অভ্যন্তরে সকল গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করবে এবং সে সাথে সড়কে হাঁটা এবং সাইকেল চালানোর ব্যবস্থাও রাখার পরিকল্পনা রয়েছে এই প্রকল্পে। এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় জন্য গণপরিবহন ব্যবস্থা বা (বিআরটি/এমআরটি) এর কার্যক্রমও এর অন্তর্ভুক্ত। যার অংশ হিসেবেই ঢাকা মেট্রো রেলের উন্নয়নে বর্তমানে ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় কাজ চলছে। এছাড়া শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শহরের বেশিরভাগ লিংক রোড এবং প্রধান সড়কগুলোকে বিভিন্ন অঞ্চলের কেন্দ্রীয় অংশের সাথেও সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে এই প্রকল্পের অধীনে।

সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন ব্যবস্থা 

ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান ২০১৬-২০৩৫ এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ এর মধ্যে একটি হল শহরবাসীদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন ব্যবস্থার সঠিক সমাধানের পথ তৈরি করা। আর তাই একবার এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে, প্রকল্পের অধীনে আবাসন সরবরাহ বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন সুযোগ যেমন সৃষ্টি হবে, তেমনি জনসাধারণের মাঝে সমানভাবে আবাসন ব্যবস্থা পৌঁছে দেয়াও সম্ভপর হবে। এছাড়াও পরিবেশগতভাবে উন্নতমানের এলাকা তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে এই প্রকল্পের অধীনে, যা সকল ক্ষেত্রেই মানুষের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে সহায়তা করবে।  

অন্য আর ১০টি প্রকল্পের মতো, ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান ২০১৬-২০৩৫ এর ক্ষেত্রেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ এর সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়তই পরিকল্পনাগুলোকে যাচাই-বাছাই করে তা সংশোধনও করা হচ্ছে। তবে এই প্রকল্পের অধীনে সবকিছুই যদি পরিকল্পনামাফিক করা সম্ভব হয়, তবে আশা করা যাচ্ছে অতি শীঘ্রই আমরা একটি সমৃদ্ধ এবং উন্নত মেগাসিটির অংশ হয়ে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নিতে পারবো। 

Write A Comment

Author