Reading Time: 5 minutes

প্রপার্টি কেনার পরিকল্পনা করছেন? ল্যান্ড, অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা গোটা ভবন, যেটাই কিনতে চান না কেন, প্রপার্টি ক্রয় মানেই বড় অংকের একটি আর্থিক বিনিয়োগ। আর এই অর্থায়ন এর জন্যই আপনার প্রয়োজন হতে পারে হোম লোন। এমন কিন্তু নয় যে, যারা অর্থের সংকুলান করতে পারছেন না, তারাই কেবল হোম লোন নিতে ইচ্ছুক। যাদের নিজেদের অর্থায়ন এর সামর্থ্য রয়েছে, তারাও কিন্তু হোম লোন নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কেননা, একবারে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার চেয়ে সাশ্রয়ী মূল্যের কিস্তিতে লোন পরিশোধ করা অনেক বেশি সহজ। এবং এতে লোন গ্রহীতাকে খুব বেশি চাপও নিতে হয় না। 

সুখবর হল, বাংলাদেশে রিয়েল এস্টেট সেক্টর এখন অনেক বেশি বিস্তৃত এবং এই চাহিদা মোকাবেলায় সরকার-অনুমোদিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সহজ শর্তে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের হোম লোন অফার করছে। যার মানে হল, হোম লোন নেয়ার জন্য এখন আপনার কাছে অনেকগুলো অপশন রয়েছে। এবং হোম লোনের প্রতিটি ধরণ সম্পর্কে জানা থাকলে আপনি সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে বিভিন্ন ধরনের হোম লোন এর মধ্য থেকে আপনার জন্য কোনটি উপযুক্ত।  আজকের ব্লগে চলুন তাহলে জেনে আসি বাংলাদেশের ৫ ধরনের হোম লোন সম্পর্কে।

Home,Loan,Housing,Investment,Concept
হোম লোন নেয়ার জন্য এখন আপনার কাছে অনেকগুলো অপশন রয়েছে

ল্যান্ড পারচেজ লোন  

এই স্কিমের অধীনে, একজন ঋণগ্রহীতা নির্দিষ্ট শর্তে এক খণ্ড জমি কেনার জন্য এই লোনটি পেতে পারেন। বেশিরভাগ ব্যাংকবা নন-ব্যাংকিং আর্থিক সংস্থাগুলি (এনবিএফআই) বাংলাদেশে এই ধরনের হোম লোন অফার করে থাকে। এরকম সহজ লোনে ল্যান্ড কিনতে পারলে, একজন ক্রেতা বাড়ি নির্মাণ এর কাজটিও অনায়াসেই করতে পারে। ল্যান্ড সবসময়ই লাভজনক একটি বিনিয়োগ হওয়ায় অনেক ঋণগ্রহীতাই শুধুমাত্র বিনিয়োগ এর জন্য ল্যান্ড পারচেজ লোন এর মাধ্যমে জমি ক্রয় করেন। তবে, জেনে রাখা ভালো এই লোন পরিশোধের মেয়াদ থাকে ১২ বছর পর্যন্ত, যার সময়সীমা অন্য সব ধরনের লোনের তুলনায় অনেক কম। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে, আপনি জমির মোট মূল্যের ৭০-৭৫% পর্যন্ত এই লোনটি নিতে পারবেন।

হোম পারচেজ লোন  

বিভিন্ন ধরনের হোম লোন এর মধ্যে বাংলাদেশের সব থেকে জনপ্রিয় লোনটি হচ্ছে বাড়ি কেনার জন্য লোন, তাতে বাড়িটি নতুন বা পুরাতন যেটাই হোক না কেন।  বাংলাদেশের সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) বিভিন্ন ভেরিয়েন্টে হোম লোন অফার করে। এবং নির্ধারিত ব্যাংক বা  আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে লোনের মেয়াদ ১-২৫ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে।

এক্ষেত্রে আপনি বাড়ির মূল্যের সর্বোচ্চ ৭০-৮৫% পর্যন্ত হোম লোন হিসেবে পাবেন। এক্ষেত্রে সুদের হার নির্ধারিত বা পরিবর্তিত যে কোনো রকমই হতে পারে। হোম পারচেজ লোন এর জন্য বাংলাদেশে সাধারণত প্রসেসিং ফি এর অতিরিক্ত চার্জসহ সুদের হার ৯% থেকে ১৪% এর মধ্যে হতে থাকে।

হোম কন্সট্রাকশন লোন 

হোম কন্সট্রাকশন লোন বিশেষত এমন গ্রাহকদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যারা আগে থেকে তৈরি বাড়ি কেনার পরিবর্তে নিজের পছন্দমত বাড়ি নির্মাণে আগ্রহী। তবে, বিশেষ এই হোম লোনটি পেতে হলে, বেশ কিছু দিক বিবেচনায় নেওয়া দরকার।

 যেহেতু এই লোনের পরিমাণটি আপনার প্রপার্টির অবস্থার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়, তাই সঠিক তথ্যের জন্য ব্যাংক বা এনএফআই এর রিলেশনশিপ ম্যানেজার এর যোগাযোগ করাই সব থেকে ভালো উপায়। উদাহরণস্বরূপ, ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন লিমিটেড ল্যান্ড প্রকিউরমেন্ট কস্ট ছাড়াও  নির্মাণ ব্যয়ের ৮০% পর্যন্ত অর্থায়ন করে থাকে। এটি সম্ভব হয়েছে কারণ, এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য বাংকের মত ৭০ঃ৩০ ডেট টু ইক্যুইটি রেশিওর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। 

হোম কন্সট্রাকশন লোন এর ক্ষেত্রে, সরকারি কর্মচারীরা এপ্রিল ২০২০ থেকে চারটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের যেকোনো একটি থেকে এবং বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে ৪% সুদের হারে লোন নিতে পারবে। কেননা, এখানে ৫% থেকে ৯% পর্যন্ত সুদ সরকারই প্রদান করে থাকে। 

হোম এক্সটেনশন লোন 

এই লোনটি এমন গ্রাহকদের জন্য করা হয়েছে, বাড়ি নির্মাণ বা প্রপার্টি ক্রয়ের জন্য নয়, বরং বাড়িতে একটি রুম যোগ করতে বা একটি ফ্লোর যোগ করতে চান। তবে এই ধরনের লোন সব ব্যাংকে পাওয়া যায় না। এজন্য বাংলাদেশের এনবিএফআই গুলো প্রয়োজনীয় তহবিলের ৭০-৮০% পর্যন্ত হোম এক্সটেনশন লোন অফার করে থাকে। লোনের মেয়াদ ২৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে। যার অর্থ আপনি চাইলে সর্বনিম্ন অংকেরইএমআই সেট করে নিতে পারেন। এখানে আপনার জন্য ইন্টারেস্ট রেটেরও অনেকগুলো অপশন রয়েছে। আপনি চাইলে  সম্পূর্ণ ভেরিয়েবল থেকে সেমি ফিক্সড কিংবা সম্পূর্ণ ফিক্সড পছন্দমত সুদের রেটটি বেছে নিতে পারছেন।  

হোম ইম্প্রুভমেন্ট লোন 

যাদের বাড়ি সংস্কার বা মেরামতের প্রয়োজন তারা বিভিন্ন রকম হোম লোন এর মধ্য থেকে এই লোনটি নিতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে ইলেক্ট্রিক ডিভাইসের আপ-গ্রেডেশন, পেইন্টিং, ওয়াটার-প্রুফিং, বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং, সিলিং এবং টাইল মেরামত সহ অভ্যন্তরীণ অন্যান্য সংস্কার।  এই লোনটির মেয়াদকাল কিন্তু অন্যান্য হোম লোন থেকে অনেক কম। এছাড়া, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে এই লোনের ইন্টারেস্ট রেট বিভিন্ন রকম হতে পারে। 

ইন্টারেস্ট রেট 

Interest,Rate,Financial,And,Mortgage,Rates,Concept.,Wooden,Home,And
লোনের ধরণ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে হোমলোনের ইন্টারেস্ট রেট বিভিন্ন রকম হতে পারে

২০২০ এর শুরুতে, হোম লোনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিটি ব্যাংকের জন্য ৯% সুদের হার নির্ধারণ করে দেয়। এবং নতুন নীতিতে, একই রকমের একটি সুদের হারের স্কিম সরকার কর্তৃক প্রণীত হয়। যেখানে বলা হয়, ২০২২ এর জুলাই থেকে যেখানে ঋণগ্রহীতারা এনবিএফআই থেকে নির্ধারিত ১১% সুদের হার উপভোগ করতে পারবে। কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখনও বিভিন্ন কারণে নির্ধারিত সুদের হারের চেয়েও বেশি অফার করছে। যার বেশিরভাগই দেয়া হচ্ছে ভেরিয়েবল ইন্টারেস্ট রেট আকারে।

প্রপার্টির নতুনত্ব 

Home,Loans,Concept,With,Calculator,And,Fountain,Pen,And,Paper
বাংলাদেশের প্রধান ব্যাংকগুলো নতুন নির্মিত প্রপার্টি ক্রয়ের জন্য হোম লোন দিয়ে বেশি আগ্রহ দেখায়

ব্যাংকগুলি সাধারণত প্রপার্টির রেজিস্ট্রেশনের তারিখের মাধ্যমে প্রপার্টিটি কত পুরাতন তা নির্ধারণ করে। সাধারণত, বাংলাদেশের প্রধান ব্যাংকগুলো পুরানো প্রপার্টির চেয়ে নতুন নির্মিত রিয়েল এস্টেট প্রপার্টি ক্রয়ের জন্য হোম লোন দিয়ে বেশি আগ্রহ দেখায়।  এতে বলা হয়েছে, ২০ বছরের বেশি পুরনো নয়, এমন প্রপার্টির জন্য হোম লোন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যদিও ইবিএল, ব্যাংক এশিয়াসহ বেশ কিছু ব্যাংক পুরানো অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ের জন্য হোম লোন সুবিধা দিতে বেশ নমনীয়।  

মাসিক আয় 

হোম লোন অনুমোদনের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার হল লোন গ্রহীতার মাসিক আয়। হোম লোন অনুমোদনের জন্য একজন সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট এর ন্যূনতম মাসিক আয়কেও ব্যাংকগুলো বিবেচনায় নিয়ে থাকে।   বাংলাদেশের বেশির ভাগ ব্যাংক গুলোই এমন চাকুরীজীবী এবং প্রফেশনালদের হোম লোন দিতে ইচ্ছুক যারা প্রতি মাসে কমপক্ষে ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। যদিও, ডাক্তার, ফ্রিল্যান্সার, কন্স্যালটেন্ট সহ স্ব-নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য এর পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে আবার কিছু ব্যাংকেসরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এ ব্যাপারে বেশ নমনীয় হয়ে থাকে।  

ডেট বার্ডেন রেশিও (ডিবিআর) 

হোমলোনের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার হচ্ছে ডিবিআর। একজন সম্ভাব্য ঋণগ্রহীতার মাসিক মোট আয়ের বিপরীতে তার লোন প্রদানের যোগ্যতা কতটুকু, এর উপর ভিত্তি করে ডিবিআর হিসাব করা হয়। সাধারণত, ডিবিআর যদি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে, তাহলে ব্যাংকগুলো লোন অফার করে না। তবে ক্লায়েন্টের আয়ের উপর নির্ভর করে ডিবিআর পরিবর্তন করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন ব্যক্তি ৪০,০০০ টাকা আয় করেন এবং তার ডিবিআর ৪৫%-এর বেশি হয়, স্বাভাবিকভাবেই, ব্যাংকগুলো সেই ব্যক্তিকে লোন প্রদান করবে না। তবে একই ব্যাংক ৬০% স্কোর করা ব্যক্তিকে হোম লোনের অনুমতি দেয়, যদি তার মাসিক আয় ২ লাখ টাকা হয়ে থাকে।

বয়স সীমা 

যেহেতু যেকোনো হোম লোন পরিশোধের মেয়াদ যথেষ্ট দীর্ঘ সময়ের জন্য অব্যাহত থাকে, তাই ব্যাংক ও এনএফআই হোম লোন অনুমোদনের প্রক্রিয়ার সময় ঋণগ্রহীতার বয়সের উপর জোর দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যাংক লোনের মেয়াদ শেষ হওয়া অব্দি সর্বোচ্চ ৬৫ বছর বয়সী ব্যক্তিদের জন্য হোম লোন অফার করে থাকে। তবে, হোম লোন পাওয়ার ন্যূনতম বয়স ব্যাংক অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।

কাজের অভিজ্ঞতার পরিধি

বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ধরনের হোম লোন পাওয়ার ক্ষেত্রে আপনার কাজের অভিজ্ঞতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বেশিরভাগ ব্যাংক সাধারণত সার্ভিস হোল্ডার এবং এবং স্ব-নিযুক্ত পেশাদারদের জন্য ২ থেকে ৩ বছরের ন্যূনতম অভিজ্ঞতা চেয়ে থাকে। কিছু ব্যাংক আবার ব্যবসায়ীদের জন্য আরেকটু বেশি সময়সীমা সেট করে দেয়।

বিভিন্ন ধরনের হোম লোন সম্পর্কে বিস্তারিত এই ধারণাটুকু থাকলে কিন্তু আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে কোন হোম লোনটি আপনার প্রয়োজন অনুসারে সবচেয়ে ভালো। প্রপার্টি ক্রয়, নির্মাণ, সংস্কার কিংবা সম্প্রসারণ যেটাই হোক না কেন, বেশিরভাগ মানুষের জন্য লোন নেয়াই অর্থায়নের প্রধান উপায়।  আর এই লোনগুলো পেতে হলে, আপনাকে অবশ্যই ব্যাংক ও এনবিএফআই থেকে নির্ধারিত গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতাগুলোও পূরণ করতে হবে। হোম লোন সংক্রান্ত আরো বিস্তারিত জানার থাকলে, প্রশ্নটি লিখে পাঠান মন্তব্যের ঘরে।

Write A Comment

Author