Reading Time: 5 minutes

যেকোন দুটো কারণে বাড়িগুলোকে ঐতিহাসিক বলা হয়ে থাকে। এক, ঐতিহাসিক কোন ব্যক্তিত্ব সেখানে বসবাস করে বলে। কিংবা ঘটে গেছে কোন মনোমুগ্ধকর কাহিনী। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, বাড়িগুলোতে ঘটে গেছে কোন ঐতিহাসিক ঘটনা। এর মধ্যে কিছু বাড়ির ঘটনা এমনই রোমাঞ্চকর যে সে ঘটনা গুলোই ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। এই যেমন, অ্যান ফ্র্যাঙ্কের বাড়ির গল্পটি কিন্তু দ্বিতীয় যুদ্ধের ইতিহাসের সাথে গভীর ভাবে সংযুক্ত। এমন আরও বেশ কিছু বাড়ি রয়েছে যেখানে আপনি খুঁজে পাবেন ঐতিহাসিক বেশ কিছু ঘটনা। তেমনি বিশ্বজুড়ে শীর্ষ ৫ টি ঐতিহাসিক বাড়ি এর ভেতরের গল্প নিয়েই আজকের ব্লগ। জানতে পড়তে থাকুন!

আয়ার্স হাউস, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া

আয়ার্স হাউস, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া
আয়ার্স হাউস, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া

দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ধনী শিল্পপতি এবং ৫ম বারের মত নির্বাচিত রাষ্ট্র প্রধান স্যার হেনরি আয়ার্স এর নামে নামকরণ করা হয়। ১৮৫৫ সালের দিকে ৯ কক্ষ বিশিষ্ট এই বাড়িটি ইজারা দেন এবং ১৮৬০ সালের দিকে এই একই বাড়িকে ৪০ কক্ষের একটি বিরাট ম্যানশনে রূপান্তর করেন। এত বিশাল বলে এই বাড়িকে অনেকে “অস্ট্রাল হাউস” হিসেবেও জানেন।  ঐতিহাসিক এই বাড়িটি নানা কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। স্যার হেনরি তার শাসন আমলে সভা, সংসদীয় ভোজন ইত্যাদিসহ সরকারী নানা উদ্দেশ্যে এই বাড়িকে ভেন্যু হিসাবে ব্যবহার করতেন। ১৯২৮ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত এই বাড়িটি যুদ্ধে আহত সৈন্যদের ক্লাব হিসাবে ব্যবহার হতো। তার এক পর্যায়ে ১৯২৬ সালে এই বাড়িটি নার্সদের প্রশিক্ষণ ও থাকার উদ্দ্যেশ্যে ব্যবহৃত হতো। এরপর, ১৮৭০ সালে ডন ডানস্তান এই বাড়িটি সংস্কার করেন এবং যাদুঘর, রেস্তোরাঁ এবং ইভেন্ট ভেন্যু হিসেবে রূপান্তর করেন। এছাড়া বাকি বাড়িটি যেমন ছিল ঠিক তেমনি সংরক্ষণ করা হয়েছে। পোশাক, রুপার পোশাক, চিত্রকর্ম, আসবাব, ৩০০ কেজি ওজনের ঝাড়বাতি ইত্যাদি যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই বাড়িটি উত্তর টেরেস, অ্যাডিলেড, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র সংরক্ষিত সম্পত্তি।  

অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক হাউস, নেদারল্যান্ড বিশ্বজুড়ে শীর্ষ ৫ ট

অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক হাউস, নেদারল্যান্ড
অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক হাউস, নেদারল্যান্ড

১৭ম শতাব্দীর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক নামের মেয়েটির জন্য এই বাড়িটি ইতিহাসের অন্যতম একটি বাড়ি হিসেবে পরিচিত। অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক ছিলেন একজন ইহুদি এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের দিনলিপিকার। যিনি কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার পরিবারসহ ধরা পরেছিলেন। এই বাড়িটি তার বাবার অফিস ছিল। এবং ইহুদি নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য তারা এই বাড়িতে লুকিয়েছিলেন। এই বাড়িটি তখন বিখ্যাত হয়, যখন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে লেখা তার ডায়রি ১৯৪৭ সালে প্রকাশ পায়। যদিও তিনি যুদ্ধের সময় জীবিত ছিলেন না কিন্তু তার লেখা ডায়েরি বিশ্বে আলোড়ন তৈরি  করে। তার ডায়েরিটি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয় এবং বই হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল। যা বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত হয়েছিল। বাড়িটি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে এবং দর্শনার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে শুরু করে। তারপরই বাড়ির মালিক সিদ্ধান্ত নেন এই বাড়িটি বিক্রি করে দেবেন কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি। জনগণ আন্দোলন করে এই বাড়িটি বিক্রির হাত থেকে বাঁচিয়ে নেয় এবং অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক ফাউন্ডেশন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরে গিয়ে ১৯৬০ সালে সম্পূর্ণরূপে একটি জাদুঘরে পরিপূর্ণ হয়। এই জাদুঘরে অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক যেখানে যেখানে লুকিয়েছেন সেই স্থানগুলোকে আলাদা করে রাখা হয়েছে এবং চিহ্নিত করাও হয়েছে। নেদারল্যান্ডের তৃতীয় সর্বাধিক দেখা যাদুঘর এটি। এবং প্রতি বছর প্রায় এক মিলিয়নেরও বেশি লোক এখানে ভিড় জমিয়ে থাকে।

গ্রেসল্যান্ড, টেনেসি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 

গ্রেসল্যান্ড, টেনেসি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 
গ্রেসল্যান্ড

খ্যাতিতে ওঠার পরপরই এলভিস প্রিসলির (আইকনিক আমেরিকান গায়ক) ১০৩৪, আডুবন ড্রাইভের বাড়িটি মানুষ এবং সাংবাদিকদের জন্য একটি জমজমাট জায়গা ছিল। এই ভিড় দেখে গায়ক বাধ্য হন বাড়ি বদলে ফেলতে। পরবর্তিতে তার নির্ধারিত বাজেট থেকে বেরিয়ে ১০২,৫০০ ডলার মূল্যের গ্রেসল্যান্ড, মেমফিসের বাড়িটি কিনে ফেলেন। এই বাড়িতে বিখ্যাত সব মানুষের আনাগোনা এতই ছিল যে এই বাড়িটিও ধীরে ধীরে বিখ্যাত হয়ে গেল। পরে মিঃ প্রেসলি বাড়িটি নিজের মত করে সাজিয়ে নিতে শুরু করলেন। বিখ্যাত জঙ্গল ঘর যেখানে ছিল সবুজ কার্পেট ও পানির ফুয়ারা। বিখ্যাত গায়ক প্রেসলির মৃত্যুর পরে গ্রেসল্যান্ডকে যাদুঘরে পরিণত করা হয় এবং ১৯৮২ সালের জুনে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ১৯৯১ সালে আমেরিকার ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এই স্থানটি রক অ্যান্ড রোল সম্পর্কিত প্রথম সাইট যা ঐতিহাসিক স্থানে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। এবং ২০০৬ সালে একে জাতীয় ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। গ্রেসল্যান্ডকে দেখতে বছরে ৬,৫০,০০০ জন মানুষ ভিড় জমান। 

উইনচেস্টার মিস্ট্রি হাউস, ক্যালিফোর্নিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

উইনচেস্টার ম্যানশনের
উইনচেস্টার ম্যানশন

উইনচেস্টার ম্যানশনের পিছনের গল্পটি রহস্যজনক হলেও বেশ আকর্ষণীয়। এই বাড়িটি ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত ভুতুড়ে বাড়ি হিসাবে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। এই বাড়িটি বেশ অদ্ভুত ভাবে নির্মিত হয়েছিল। যেমন, দরজা আছে কিন্তু এই দরজা দিয়ে আপনি কোথাও পৌছাতে পারবেন না। সিঁড়ি আছে কিন্তু এই সিঁড়ি দিয়ে কোথাও উঠতে পারবেন না। অনেক দর্শনার্থী এবং অতিথি যারা বাড়িতে গিয়েছিলেন, থেকেছিলেন তারা অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা পেয়েছিলেন এবং বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে অস্বস্তি বোধ করেছিলেন। এই বাড়িটির পেছনের গল্পে রয়েছে এক বিশাল ট্র্যাজেডি। সারা উইনচেস্টার তার সন্তান ও স্বামীকে হারিয়ে হতাশায় ভুগছিলেন। এরপর বোস্টন মিডিয়াম এর কাছে পৌঁছান তার এই কষ্ট আর হতাশা দূর করার জন্য। কিন্তু, তিনি এমন কিছু শুনতে পারলেন বোস্টন মিডিয়াম থেকে যা শোনার জন্য তিনি একদমই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি জানতে পারেন, যেহেতু তার স্বামী উইলিয়াম উইচেস্টার একজন অস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন তাই তিনি অনেকগুলো রাইফেল তৈরি করেছিলেন। যে রাইফেল ব্যবহার করে অনেক মানুষের প্রাণ গেছে বলে, সাড়া উইনচেস্টারের জীবনে এমন দুঃখ ও হতাশা আছে। মিডিয়াম আরও বলেন, তিনি যদি সতর্ক না হোন সামনে গিয়ে তার আরও ক্ষয়ক্ষতির মুখে পরতে হবে। এবং এই আসন্ন বিপদের প্রতিকার ছিল এমন একটি বাড়ি তৈরি করা যা ভালো আত্মাদের আকর্ষণ করবে এবং খারাপ আত্মা থেকে সারাকে রক্ষা করবে। এই উপদেশ শুনে সারা সাথে সাথে ছুটে গেলেন, নিউ হ্যাভেন থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোসে-তে। আট কক্ষের একটি ফার্মহাউস নির্মাণ করতে লাগলেন এবং ৬ মাসের ভেতর সেই ৮ কক্ষ ২৬ কক্ষে পরিণত হল। এবং, উইনচেস্টার নির্মাণ কর্মীরা সেখানে ২৪ ঘন্টা থেকে ৩৮ ঘন্টা শিফটে কাজ করতে লাগলেন। তবে এই নির্মাণ কাজের নাকি কোন শেষ ছিল না।   

হাইক্লেয়ার ক্যাসেল, ইংল্যান্ড 

হাইক্লেয়ার ক্যাসেল
হাইক্লেয়ার ক্যাসেল

ইংল্যান্ড অনেক আগে থেকেই বেশ বিখ্যাত কেননা, বিশ্বের সব চমৎকার স্থাপনা সেখানেই আছে যেমন, বাকিংহাম প্যালেস। তবে বিশ্বজুড়ে শীর্ষ ৫ টি ঐতিহাসিক বাড়ি এর কথা বললে ইংল্যান্ডের হাইকলার ক্যাসেল তালিকার শীর্ষে থাকবে। ১৬৭৯ সালে নির্মাণ করা এই বাড়িটি ১৮৪০ সালে বড় করে সংস্কার করা হয়েছিল এবং এই বাড়িটি গ্রেড ওয়ান কান্ট্রি হাউজ। অনেক ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্ব এই বাড়িতে থেকেছেন। এমনকি কানাডা গঠিত হওয়াতেও এই দেশের বড় ভূমিকা রয়েছে। কিং এডওয়ার্ড দ্বিতীয় থেকে শুরু করে স্যার রবার্ট সাওয়ের, অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে চার্লস দ্বিতীয় এবং জেমস দ্বিতীয় সেখানে যারাই বসবাস করেছিলেন তাদের প্রত্যেকেই নির্মাণ বৈশিষ্ট্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এবং এর বাগানটিও ছিল দেখতে চমৎকার, ক্যাপাবিলিটি ব্রাঊন এই বাগানের নকশা করেছিলেন। এই বাড়িটির সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক তাত্পর্যের জন্য, হাইক্লেয়ার ক্যাসল বিভিন্ন চলচ্চিত্র এবং টিভি সিরিজের সেট ও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পেয়েছিল বিখ্যাত টিভি সিরিজের সেট হিসেবে ব্যবহৃত হবার পর। সেই সিরিজের নাম ছিল, ডাউনটন অ্যাবে। গ্রীষ্মের সময়কালে, ক্রিসমাস এবং ইস্টার উপলক্ষে এই বাড়ির বাগান, ঘর এবং মিশরীয় প্রদর্শনীগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

এই ছিল বিশ্বজুড়ে শীর্ষ ৫ টি ঐতিহাসিক বাড়ি এর ইতিকথা। কেমন লেগেছে আজকের এই বাড়ির গল্পগুলো। জানাতে কমেন্ট করুন।

Write A Comment