Reading Time: 4 minutes

ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে

যুদ্ধে ছিন্ন ঘরবাড়ি দেশ

মাথার ভিতরে বোমারু বিমান

এই কালো রাত কবে হবে শেষ

শত শত মুখ হায় একাত্তর

যশোর রোড যে কত কথা বলে

এত মরা মুখ আধ মরা পায়ে

পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে

পূর্ব বাংলা আদতেই সেদিন কলকাতা চলছিল। কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত সীমান্তে। সীমান্তজুড়ে শরণার্থী শিবিরগুলো হয়ে উঠেছিল একেকটি বাংলাদেশ অথবা বাংলাদেশ নামের একেকটি ঘর। শরণার্থী শিবির যখন ঘর হয়ে ওঠে, তখন কেমন হয় সেখানকার চালচিত্র? কেমন হয় একটি যুদ্ধছিন্ন ঘর-বাড়ি-দেশের চেহারা? কোথায় গিয়ে ঠেকে শরণার্থীদের ভাতের ক্ষুধা কিংবা ছেঁড়া সংসার? বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সেই ইতিহাস জানার ও জানানোর কিছুটা দায় আমাদেরও আছে বৈকি! 

তেরশ’ মাইল সীমান্ত পেরিয়ে  

৭১ এর শরণার্থী
দু মুঠো খাবার, নিরাপত্তা আর একটু আশ্রয়ের খোঁজে তাদের গন্তব্য সীমান্ত জুড়ে থাকা শরণার্থী শিবিরগুলো

উত্তাল ৭১। টিকে থাকার তাগিদে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহর, স্বজন হারানো, সম্ভ্রম হারানো, স্বামী-সন্তান-গৃহ হারানো লাখ লাখ শরণার্থী ছুটে যাচ্ছে সীমান্তের দিকে। দু মুঠো খাবার, একটু নিরাপত্তা আর একটু আশ্রয়ের খোঁজে তাদের গন্তব্য সীমান্ত জুড়ে থাকা শরণার্থী শিবির। যদিও পথের দূরত্ব ১৩০০ মাইল অথবা তারও বেশি। তারপরও তারা হেঁটে যাচ্ছে কাঁদা মাটি পথ, অতিক্রম করছে ঘন জঙ্গল। হয়তো সীমান্ত পার হবার আগেই ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছে ক্লান্ত বৃদ্ধা, মায়ের কোলেই থেমে গেছে অসুস্থ শিশুর শেষ নিঃশ্বাস। কোথাও হয়তো নদী পাড়ি দিয়ে আরেকটু যেতে পারলেই সীমান্ত। কিন্তু তার আগেই ধরা পড়েছে পাকিস্তানিদের হাতে।   

১৯৭১ এর ৩০ এপ্রিল অমৃতবাজার পত্রিকায় একটি খবরের শিরনাম ছিল “ভারতে যাবার পথে ৯০০ শরণার্থী নিহত।” এভাবেই ঘন্টাখানেকের মধ্যে শরণার্থীদের লাইনে কমে গিয়েছে মানুষের সংখ্যা, বেড়েছে লাশের মিছিল। তবুও যারা বাঁচতে পেরেছিল, তাদের গন্তব্য শরণার্থী শিবির। যাবার পথে এক বেলার আহার জোগাড় করতে কেউ হয়তো বেচে দিয়েছে থালা বাসন, কেউ বেচেছে মায়ের একমাত্র স্মৃতি সোনার বালা জোড়া, কেউ বা তার শেষ সম্বলটুকু। যদি একবেলা আধ পেট খেয়ে বেঁচে থাকা যায়, তাহলেই তো পথ হাটা যাবে শরণার্থী শিবিরের দিকে! মাথার ভেতর কেবল বেঁচে থাকার এই হিসাবটাই মুখ্য তখন। যদিও সবার ক্ষেত্রে সে হিসাবটাও মেলেনি ঠিকঠাক। কেউ বন্দুকের নলের সামনে থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে, কেউ ধর্ষিত হয়েছে, কেউ হয়তো হেঁটে চলেছে শরীরে গুলির ক্ষত নিয়ে। ছুটতে থাকা এ মানুষগুলোর সঙ্গী তখন কেবল যুদ্ধের বীভৎস স্মৃতি। 

‘অক্সফাম’ ১৯৭১ এর অক্টোবর মাসে ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি’ নামে প্রকাশ করে একটি প্রচারপত্র। তাতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় রলফ র‍্যাঞ্জ লেখেন, ‘মানুষের অন্তহীন এক স্রোত। এরা সব শরণার্থী। আমরা ৫০০ গরুর গাড়ি গুনলাম। গাড়ির দুই পাশে হেঁটে চলা মানুষ। তারা দ্রুত হাঁটতে চেষ্টা করছে। হাত ওপরে তুলছে এবং চিৎকার করতে শুরু করেছে। মনে হলো, তাদের দুরবস্থার কথা আমাদের জানাতে তারা উদগ্রীব। কয়েকজন দৌড়ে আমাদের কাছে এসে যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে আঙ্গুল তুলে বলতে শুরু করল। যদিও আমরা কেউ বাংলাভাষী নই, তবুও তাদের কথা বুঝতে আমাদের সমস্যা হলো না। যে গ্রাম ছেড়ে তারা আসতে বাধ্য হয়েছে তা আগুনে পুড়ছে। সাদা চুলের একজন বুড়ো মানুষ আকাশের দিকে হাত তুলে কেঁদে উঠল। অঙ্গভঙ্গিতে আমাদের জানাল, তার আটটি সন্তানের সব কয়টি নিহত হয়েছে।’

ঘরহীন ভাসে শত শত লোক

শরনার্থী শিবির
ছোট কুটিরের ছাউনি, ছোট তাবু, সিমেন্টের শিট বা ড্রেইনের পাইপ, এই ছিল শিবিরগুলোয় শরণার্থীদের ঘর

সুখেন্দু সেন নিজের অভিজ্ঞতা জড়ো করে “শরণার্থী ৭১” এ লিখেছিলেন ‘বন্যার আগাম আভাস পেয়ে গাছ বেয়ে ওঠা পিঁপড়ের সারির মতো, দুর্গম পথ, নদী-খাল, বন-বাদাড়-জঙ্গল অতিক্রম করে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভবিষ্যতের আশঙ্কা সঙ্গী করে ক্রমাগত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ের তেরশ’ মাইল সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থীরা ভারতে ঢুকছে। প্রথমে স্কুল, কলেজ, রেলস্টেশন, পরিত্যক্ত বাড়ি-আঙিনা, সরকারি স্থাপনা, হাটবাজারের চালা, খালি গুদামঘরের আশ্রয়। ক্রমে বাঁশ আর উপরে ত্রিপল টেনে সারি সারি খুপরি।’ 

প্রতিদিন শুধু যশোর রোড দিয়েই সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে ৩০ হাজারের মতো শরণার্থী। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারতে আশ্রয় নেওয়া এই শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়, ভারতের সীমান্তবর্তী প্রত্যেক এলাকাজুড়ে তখন শরণার্থী শিবির। ছোট কুটিরের ছাউনি, ছোট তাবু, সিমেন্টের শিট বা ড্রেইনের পাইপ, এই ছিল শিবিরগুলোয় শরণার্থীদের ঘর। কিন্তু এত অজস্র রিফিউজির সংকুলান সেখানেও করানো যায় নি। অতঃপর খোলা আকাশ, যুদ্ধ শেষ হওয়া অব্দি ওটাই তাদের আশ্রয়, কিংবা ঘর। ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি’তে জুলিয়ান ফ্রান্সিস লিখেছিলেন, ‘অঝোর ধারায় বৃষ্টিতে পরিবারগুলো ভিজে জবুথবু, তাদের মাঝে কাপড় শুকানোর দড়ি ছাড়া দুটি পরিবারকে আলাদা করার মতো কোনো দেয়াল নেই। খড়ের তৈরি ছাউনি বৃষ্টির কাছে অসহায়, মাটির বিছানা ভিজে একাকার। প্রতিনিয়ত কুটিরগুলো থেকে শত শত শরণার্থী সরকারি রেশনের জন্য লাইন ধরছে, পানি ও পয়ঃনিস্কাশনের জন্য তাদের সারিও চোখে পড়ার মতো। আমাশয়ে আক্রান্তরা খুব কমই নিজেদের ধরে রাখতে পারছে। শিশুরাও তাদের বিশেষ পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’  জুলিয়ান আরও লিখেছিলেন, ‘এই হচ্ছে ৯০ লাখ শরণার্থীর জীবনচিত্র। যাদের কোনো কাজ ছিল না, ছিল না পয়সাকড়িও। তবে তারা জানত, কেন তারা এসেছে। তারা এ-ও জানত, এ জায়গাটাই তাদের জন্য নিরাপদ। জীবন বাঁচানোর জন্য এখানে আসা ছাড়া যে গত্যন্তর নেই।’

খোলা আকাশের নিচে গাদাগাদি করে থাকা এই রিফিউজিদের জন্য প্রকৃতিও সদয় হয় নি। অনেক শরণার্থী শিবির ছিল নিচু এলাকায়। বর্ষাকালে একটু বৃষ্টি হলেই সেখানে পানি জমেছে। বর্ষার দিনে পানির মধ্যে সারারাত দাঁড়িয়েই কেটেছে মানুষগুলোর। তারপর হয়েছে নিউমোনিয়া। কিন্তু এত অগণিত অসুস্থ-অভুক্ত রোগীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত ডাক্তার বা ঔষুধপত্র। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে অসংখ্য শরণার্থী।ক্যাম্পগুলোতে আরও ছিল খাবার পানির অভাব। পানিশূণ্যতায় ভুগেছে অজস্র লোক! খাবারেরর অভাব এতোটাই ছিল যে, শিশুদের বুকের পাঁজরের হাড় পর্যন্ত গোনা যেত। কেবল অপুষ্টিতে ভুগে মারা গিয়েছিল কয়েক লক্ষ শিশু। এই দুর্বিষহ সময়ে জন্ম নিয়েছিল যে সমস্ত শিশু, তাদের বাস্তবতা তো আরও নির্মম! কেউ জন্ম নিয়েছে গাছ তলায়, কেউ নৌকায়, কেউ শরণার্থী শিবিরে। অপুষ্টির কারনে মায়ের বুকেও দুধ নেই। কত মা ক্ষুধার কষ্টে শিশুকে ফেলে পালিয়েছে! তাকেই আবার কুড়িয়ে নিয়েছে সন্তানহারা অন্য আরেক মা। শরণার্থী শিবির নামের এই ঘর গুলোয় সবকিছুর অভাব থাকলেও চোখের জলের অভাব ছিল না। কেউ কাঁদছে ক্ষুধার কষ্টে, কেউ সন্তানের জন্য, কেউ সম্ভ্রবহানির লজ্জায়, কেউ হয়তো পরিবারের সবাইকে হারিয়ে! হাজারো অনিশ্চয়তার মাঝে ক্যাম্পগুলোয় সবচেয়ে বেশি সহজ ছিল মরে যাওয়া। অথচ মরতে মরতেও মানুষগুলো স্বপ্ন দেখেছিল দেশ স্বাধীন হলে ঘরে ফেরার! স্বপ্ন দেখেছিল ফেলে আসা ফসলের মাঠে আবার সোনা ধান ফলাবার। 

আজকে এই স্বাধীন দেশে বসে সেই ক্ষুধার্ত, অনাবৃত, রুগ্ন মানুষগুলোর আলেখ্য সেই স্বপ্ন কিংবা দুর্দশার মূল্য আদৌ কি চুকানো সম্ভব?   

   

Write A Comment

Author