ম্যুরাল বা দেয়াল চিত্র। ঊনবিংশ শতকের প্রায় শেষের দিক থেকে দেয়ালে বা সিলিংয়ে এই ধরনের ম্যুরাল বা দেয়াল চিত্র করা হতো। জনসাধারণের মধ্যে শিল্পচেতনা জাগ্রতের জন্য দেয়ালে চিত্র আঁকা হতো। কোন একটা প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে দেয়ালে এই চিত্রগুলো আঁকা হতো। দেয়ালের এই চিত্রগুলো বড় আকারে হতো তাই দেয়ালে আকার জন্য আলাদা দেয়াল চিত্রকারীই রয়েছে। তাদেরকে ম্যুরাল আর্টিস্টও বলা হতো। ম্যুরাল যে কেবল শিল্পকর্ম তা নয়, সামাজিক সমস্যা মুক্তির বা রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার এটি। কখনও কখনও আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে ম্যুরাল তৈরি করা হয়েছে আবার কখনো ইন্টেরিয়রের সৌন্দর্যের জন্য স্থানীয় রেস্তোরাঁ বা কফি শপে বসানো হয়েছে। আজ লিখবো বিশ্বজুড়ে সেরা কয়েকটি শহুরে দেয়াল চিত্র নিয়ে। চলুন শুরু করা যাক…
আই হার্ট, নো বাডি লাইকস মি
ভ্যানকুভার, কানাডা

অল্পবয়সী ছেলে হাতে মোবাইল ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ অবয়বে তার যন্ত্রণা। সে যেন চিৎকার করছে। চিৎকার করে যেন কি বলতে চাচ্ছে! ছেলেটির মাথার উপর ইনস্ট্রাগ্রামের লাইক, কমেন্টের আইকন দেয়া। এই আইকনে লাইক ও কমেন্টের সংখ্যা দেখানো হয়েছে শূন্য। প্রযুক্তির এই যুগে যেখানে আমরা ইন্টারনেটের সুবাদে অনেকটা সংযুক্ত, কিন্তু বাস্তবে আমরা ঠিক ততটাই আলাদা আর দূরে। প্রতিটা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে চেনা অচেনা মানুষের তৎপর আনাগোনা, সবার লাইক কমেন্ট আমাদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। “নো বাডি লাইকস মি” শিরোনামে এই দেয়াল চিত্রটি সোশ্যাল মিডিয়া ও বাস্তব জীবনের ব্যবধানটাই উপস্থাপন করছে। যাদের আমরা ব্যক্তিগতভাবে চিনি না তেমন মেলামেশাও নাই তাদের মতামত আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর।
গার্ল উইথ বেলুন
লন্ডন, ইউকে

২০১৭ সালে “গার্ল উইথ বেলুন” ব্রিটেনের প্রিয় শিল্পকর্মের উপাধি পায়। দেয়াল চিত্রটিতে ফুটে উঠেছে, একটি শিশুর হাত থেকে হৃদয় আকৃতির বেলুন একটু একটু করে দমকা হাওয়ায় দূরে সরে যাচ্ছে। হৃদয় আকৃতির এই বেলুনটি হচ্ছে ভালোবাসা আর আশার প্রতীক। যা কিনা অল্পবয়সী মেয়ের একরঙা সিলুয়েট বা ছায়ার, নাগালের বাইরে ভেসে যায়। ছোট এই বেলুনের মাধ্যমে চিত্রকার ব্যাঙ্কি দেখাতে চেয়েছেন, মানুষের অনুভূতিগুলো ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতির এবং কীভাবে দমকায় হাওয়ায় অনেক সহজে সেগুলো দূরে সরেও যেতে পারে। মানব অনুভূতির মূল্য বোঝাতেই এই দেয়াল চিত্রটি করা হয়েছে। সবার অনুভূতির প্রতি আমাদের যত্নশীল হতেই এই দেয়াল চিত্রটি আঁকা হয়েছিল।
ভিলস, ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার
হং কং

শহুরে দেয়াল চিত্র এর আলাদা একটি জায়গা রয়েছে এটি কেবল শিল্পকর্ম নয়, এটি আন্দোলনের ভাষাও! যুগে যুগে দেয়াল চিত্রের মাধ্যমে সে ভাবনাগুলোকে ব্যক্ত করা হয়েছে যেগুলো সচারাচর সবার সামনে বলা যেত না। এমনই একটি দেয়াল চিত্র ভিলস এর ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার। বিশ্বজুড়ে শহরগুলিতে চিত্রকার ভিলস প্রায়শই শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের ক্ষতিকর পরিণতিগুলো নিয়ে দেয়াল চিত্র আঁকতেন। এমনই ২০১৫ সালে ভিলস হংকংয়ের সুয়েন ওয়ানে একটি নান ফুং টেক্সটাইল ভবনের দেয়ালে একজন প্রাক্তন কারখানার শ্রমিকের প্রতিকৃতি আঁকেন। শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরতেই তিনি এমন দেয়াল চিত্র আঁকতেন।
কিথ হ্যারিং, উই দ্য ইয়ুথ
ইউএসএ

আমেরিকান দেয়াল চিত্রকার, কিথ হ্যারিং, শুধুমাত্র একজন ম্যুরাল শিল্পী ছিলেন না, তিনি একজন সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্টও ছিলেন। তার তৈরি করা বৃহৎ আকারের দেয়াল চিত্রগুলো সমকামিতা এবং এইডসের মত সোশ্যাল ট্যাবুগুলোকে প্রকাশ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করতো। তিনি তার দেয়াল চিত্র নিয়ে বরাবরই সাহসী ছিলেন। তার দেয়াল চিত্রকে অনেকেই ভিজ্যুয়াল কবিতা বলেও সম্বোধন করে। ১৯৮৭ সালে তৈরি উই দ্য ইয়ুথ হল একমাত্র বিখ্যাত ম্যুরাল যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দুইশত বছর পূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য “আমরা জনগণ” এই শ্লোগানের তালে তালে আঁকা হয়েছিল।
ছবি একে মনের ভাব প্রকাশের কৌশল নতুন নয় বেশ পুরনো! কিন্তু, দেয়ালে চিত্র একে সমাজদের বিদ্যমান সমস্যাগুলো চোখে আঙ্গুল দেখানো হতে পারে যুগান্তকারী একটি উপায়। তেমনি কিছু যুগান্তকারী শহুরে দেয়াল চিত্র নিয়ে লেখা হয়েছে আজকের ব্লগ। কেমন লেগেছে এই শহুরে দেয়াল চিত্রগুলো আপনাদের? জানাতে কমেন্ট করতে ভুলবেন না!