মিশরের গিজা’র পিরামিডগুলোর প্রতি আমাদের আগ্রহের যেন কোন শেষ নেই। সভ্যতার শুরু থেকেই বিভিন্ন নির্মাতা এবং স্থপতিরা তাদের স্রষ্টার সন্তুষ্ট লাভ করতে বা সম্মান জানাতে এই পরামিডগুলো তৈরি করেছিলেন। আমরা যখন একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করি তখন শহর শব্দটি শুনলেই মনের অজান্তে আকাশচুম্বী ভবনগুলোর কথাই কল্পনা করতাম। আরবান স্কাইলাইনগুলোও উঁচু ভবনের এক বিশাল বন হয়ে উঠেছে। দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা বা কুয়ালালামপুরের পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের মতো আকাশচুম্বী ভবনগুলো এখনো বিশ্বের কাছে একটি বিস্ময়। কিন্তু, সময়ের আগেও আমাদের কাছে এত স্কাইস্ক্র্যাপার ছিল না। মানে এমন শহরও খুঁজে পাওয়া যাবে যেখানে স্কাইস্ক্র্যাপার একদমই নেই। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপ রোমের মতো বড় বড় মহানগরীতে নেই কোন স্কাইস্ক্র্যাপার। তাহলে এই স্কাইস্ক্র্যাপারগুলো এলো কোথা থেকে ? চলুন তো স্কাইস্ক্র্যাপারের ইতিহাস সম্বন্ধে জেনে আসি।
শুরু দিকেকার কথা

আকাশচুম্বী বা স্কাইস্ক্র্যাপার শব্দটি ১৮৮০ সালের দিকে ১০ থেকে ২০ তলা বিশিষ্ট ভবনগুলোকে বর্ননা করতে গিয়ে এসেছে। যা শীঘ্রই ২০তম শতাব্দীর দিকে পরিবর্তন হতে শুরু করে। স্কাইস্ক্রেপার্সের আবিষ্কারটি একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ যে একটি শহর উদ্ভাবকদের সৃজনশীলতার সাথে নিজেই নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে পারে। গিজার সুউচ্চ পিরামিডগুলো অন্যতম মনুষ্য নির্মিত কাঠামো যা ফেরাউন এবং প্রকৌশলিরা নির্মাণ করেছিলেন। হাজার হাজার বছর ধরে এগুলো সকলের মন কেড়ে নিচ্ছে। তবে চতুর্দশ শতাব্দীতে এসে গির্জার স্পায়াররা ৪৮১ ফুটের বেশি উচ্চতায় ভবন তৈরি করতে লাগলেন। ইংল্যান্ডের লিংকন ক্যাথেড্রাল ১৩১১ সালে সর্বপ্রথম সেই রেকর্ড ভেঙ্গেছিল ৫২৫ ফিটের ভবন তৈরি করে। কিন্তু এটি শক্তিশালী ঝড় দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। এর ধ্বংসের পরে, দীর্ঘতম কাঠামোর মুকুট পেয়ে যায় গির্জার টাওয়ারগুলো। সেন্ট মেরি স্ট্র্যাসল্যান্ড, স্ট্রেসবার্গ, হামবুর্গ সেন্ট নিকোলাই, রউইন নটরডেম। এবং অবশেষে ১৮৮০ সালে নির্মিত হয় ওয়াশিংটন স্মৃতি স্তম্ভ। তারপর ১৮৮৭ সালে ৩০০ মিটার উঁচু আইফেল টাওয়ার নির্মিত হয়।
আয়রন কাঠামো

আইফেল টাওয়ারের আয়রন কাঠামোটি প্রথম স্কাইস্ক্র্যাপারের ইতিহাস এর অন্যতম একটি নির্মাণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। লোহার অবকাঠামো এই ভবনটির সম্পূর্ণ ওজন বহন করে থাকে। এবং লিফটে কনড্রাম ছিল কারন এই লিফটে কোনও সুরক্ষা উপাদান ছিল না। তাই ১৮৫৭ সালে এলিশা গ্রাভস ওটিস একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এসেছিলেন যাতে করে এই লিফটে কোন বিপজ্জনক ঘটনা না ঘটে। বৈদ্যুতিক মোটর দ্বারা চালিত এই লিফট দিয়ে ভবনের শীর্ষে উঠা নামা করা যেত বেশ সহজে। এরপরেই স্থপতিরা উচ্চ ভবনগুলোতে এই দুটি মৌলিক জিনিস ব্যবহার শুরু করেছিলেন। যার ফলে নির্মাণ হয়েছিল আরও বিস্ময়কর কয়েকটি ভবন, যেমন- শিকাগোর ৪৫ মিটার (১৪৮ ফুট) লম্বা র্যান্ড ম্যাকনালি বিল্ডিং, সেন্ট লুই এর (১৩৫ ফুট) লম্বা ওয়াইন রাইট বিল্ডিং এবং মিসৌরির ১০৩ মিটার (৩৩৮ ফুট) লম্বা নিউইয়র্কের সুরেটি বিল্ডিংগুলো ছিল বেশ চমৎকার। যা বেশ কয়েক বছরের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম বিল্ডিং হিসেবে পরিচিত ছিল।
মডার্ন স্কাইস্ক্র্যাপার

বিশ শতকের প্রথম দিকের ঠিক পরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৩০ সালের মহামন্দার কারণে আকাশচুম্বী নির্মাণগুলো তিন দশকের দীর্ঘ যুগে প্রবেশ করেছিল। এরপরে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন শুরু করেছিল মস্কোতে আকাশচুম্বী একটি সিরিজ নির্মাণ করতে। এরপরেই এই ট্রেন্ডটি শীঘ্রই জার্মানি, পোল্যান্ড, ইউক্রেনসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে প্রবেশ করে। এরপরে, ১৯৩০ সাল থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার পাশাপাশি ল্যাটিন আমেরিকার শহরগুলো সহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আকাশচুম্বী এই ভবনগুলো দেখা শুরু হয়েছিল। এবং ১৯৫০ এর শেষ থেকে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া এবং ওশেনিয়ার শহরগুলোতেও এই ভবনগুলো নির্মান হতে থাকে। তবে ততক্ষণে একটা জিনিস বদলে গিয়েছিল; স্ক্র্যাসিক্যাল ডিজাইন অনেকেই প্রত্যাখ্যান করেছিল। পরিবর্তে, সমস্ত প্রকল্পের নির্মাণে স্টিল বা কংক্রিট ফ্রেমওয়ার্ক ও গ্লাস ও পাথরের দেয়াল ব্যবহার করতে শুরু হয়েছিল। এভাবেই সময়ের সাথে স্কাইস্ক্র্যাপারের ইতিহাস বদলে যেতে থাকে। ১৯৬০ দশকের গোড়ার দিকে ফজলুর রহমান খান নামে এক বাংলাদেশী-আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার এবং স্থপতি দ্বারা “নল বা টিউব” কাঠামোর ব্যবস্থা চালু করেছিল। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে শুধু স্টিল ফ্রেম কাঠামোই এই স্কাইস্ক্র্যাপার নির্মাণের একমাত্র উপায় ছিল না।
শীর্ষের পথে

দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতায় মেতেছিল গোটা বিশ্ব। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কর্পোরেট ভবন নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৩০ সালে মেট্রোপলিটন লাইফ ইন্স্যুরেন্স টাওয়ার (৭০০ ফুট), ওয়ালওয়ার্থ বিল্ডিং (৭৯২ ফুট) এবং ক্রাইসলার বিল্ডিং (১,০৪৬ ফুট) প্রথম স্থান পেয়েছিল বিশ্ব উঁচু ভবনের তালিকায়। ১৯১২ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ১১০টি তলা নিয়ে নির্মিত হয় ১,৩৬৮ ফুট উপরে। তবে কেবল দুই বছর ধরে শীর্ষস্থানটি ধরে রাখতে পেরেছিল। ২০০৪ সালে ১৬৭০ ফুট উচ্চতা নিয়ে গড়ে উঠেছিল তাইপেই ১০১ ভবনটি। এবং জানুয়ারী ২০১০ সাল পর্যন্ত তার অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল কিন্তু অভ্যুত্থান হয় বুর্জ খলিফার, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম ভবন হিসেবে। ১৬০ তলা বিশিষ্ট এই ভবনটি ২,৭১২ ফুট উচ্চতা নিয়ে নির্মিত। বুর্জের রয়েছে বিশ্বের দ্রুততম লিফট।
ভবিষ্যতের দীর্ঘতম বিল্ডিং

বিশ্বের সব উঁচু নির্মাণাধীন বিল্ডিংগুলো মধ্যে সৌদি আরবের জেদ্দা টাওয়ারটি সকল বিল্ডিংয়ের জন্য সবচেয়ে উঁচু ভবনের পুরস্কার দাবি করবে। বর্তমানে কিছু কারণে নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। তবে, উচ্চতার দিক দিয়ে ৩,৩০৭ ফুট প্রসারিত এই ভবনটি। টোকিওতে স্কাই মাইল টাওয়ারের পরিকল্পনা রয়েছে যার নির্মাণ কাজ শেষ হলে, ৪০০ এরও বেশি তলাসহ ৫,৫৭৭ ফুট দীর্ঘ হবে এই ভবনটি।
স্কাইস্ক্র্যাপারের ইতিহাস সময়ের সাথে আরও বাড়বে এবং আরও সমৃদ্ধ হতে যাচ্ছে। বিশেষঙ্গের পরামর্শ মেনে এই উঁচু ভবনগুলো তৈরি করা উচিত নয়তো বা ঘটতে পারে কোন দুর্ঘটনা। স্কাইস্ক্র্যাপারের ইতিহাস সম্বন্ধে জেনে কেমন লেগেছে জানিয়ে দিন।