আমার দাদীকে দেখতাম ঘরের কোণে জমিয়ে রাখছেন খালি কৌটা, পুরোনো ম্যাগাজিন। এমনকি আমাদেরও ফেলতে দিতেন না পুরোনো প্যাকেট, কার্ডবোর্ড বক্সসহ আরো অনেক কিছুই। জমিয়ে রাখার কারণ হিসেবে প্রতিবার বলতেন, ‘পরে কখনও কাজে লাগবে!’ এরপর চলে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। জমিয়ে রাখা সেসব জিনিসের বেশিরভাগই এখন অব্যবহৃত বা ব্যবহারের অযোগ্য, কিন্তু আমাদের ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়ির অনেকটা জায়গা দখল করে আছে অপ্রয়োজনীয় এসব জিনিসের স্তূপ। কোনো কারণ ছাড়াই এভাবে জিনিস জমিয়ে রাখার অভ্যাস আমাদের অনেকেরই আছে, আর এ অভ্যাসকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘হোর্ডিং’। হোর্ডিংয়ের ফলে সৃষ্টি হয় নানান ঝামেলা, তাই বিশ্বব্যাপী হোর্ডিং বা জমানোর সমস্যা সমাধান নিয়ে হচ্ছে অনেক রকম আলোচনা। আজকের ব্লগে আমরা আপনাদের জানাবো হোর্ডিং নিয়ে বিস্তারিত।
হোর্ডিং কেন করা হয়?
হোর্ডিং একেবারেই নতুন কোনো বিষয় নয়। হার্ভার্ড হেলথ ব্লগের তথ্যমতে, ২% থেকে ৬% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে হোর্ডিংয়ের অভ্যাস থাকে। তবে, এর বেশ কিছু কারণও আছে। কারো কাছে জমিয়ে রাখা জিনিসগুলো স্মৃতিচিহ্ন, কারো কাছে তা নিজের সত্ত্বার অংশ।
অবশ্য অনেক সময় শুধুমাত্র মায়ার কারণেও অনেক কিছু ফেলা হয়ে ওঠে না। যেমন, প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে যে স্যুভেনিয়ারটি সংগ্রহ করেছিলেন, তা ক্ষয়ে গেলে বা ভেঙ্গে গেলেও আমরা ফেলতে চাই না, মনে হয় ফেলে দিলে যেন তা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে সেই ভ্রমণের স্মৃতিটুকুও। আবার, আমার দাদীর মতো অনেকে হোর্ডিং করেন পরে সেসব ব্যবহারের মনোভাব থেকে।
হোর্ডিং এর নানান অসুবিধা
হোর্ডিং এর অসুবিধাগুলো হোর্ডার (যিনি জিনিস জমিয়ে রাখেন) এবং তার পরিবারের সদস্যদের জন্য নানা ঝামেলা সৃষ্টি করে। প্রথমত, অপ্রয়োজনীয় জমিয়ে রাখা জিনিসের স্তূপ ঘড়ের পরিচ্ছন্নতার পরিপন্থী। দ্বিতীয়ত, অনেক জায়গা দখল করে বলে ছোট বসতবাড়িতে হোর্ডিং এর ফলে সৃষ্ট জটিলতা আরো বেশি। কেননা, তা চলাচলে ও বসবাসে অসুবিধা তৈরি করে। এগুলোতে ধুলো জমে, যা থেকে শ্বসনতন্ত্রের রোগ হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। বাড়িতে নানা অস্বাস্থ্যকর প্রভাব যেমন পোকামাকড়-ইঁদুরের উৎপাত, অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে জমিয়ে রাখা এসব জিনিসের কারণে। এমনকি হোর্ডারের সাথে বসবাসও বেশ ঝামেলার অভিজ্ঞতা, স্বভাবতই অকারণ জমিয়ে রাখার এ অভ্যাসের ফলে জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় আর দানা বাধে বিরক্তি। এসব কারণেই হোর্ডিং বা জমানোর সমস্যা সমাধান নিয়ে কাজ করা খুবই জরুরি।
হোর্ডিং বা জমানোর সমস্যা সমাধান করা যায় কীভাবে?
আসুন জেনে নেয়া যাক, সহজ ও যথার্থ উপায়ে হোর্ডিং বা জমানোর সমস্যা সমাধান করা যায় কীভাবে। তবে প্রথমেই কোন জিনিসগুলো জরুরি আর কোনটি জরুরি না তা চিহ্নিত করতে কিন্তু, একেবারেই ভুলবেন না। এক্ষেত্রে আপনি জিনিসগুলোকে তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করতে পারেন-
- যা রাখবেন
- যা রাখবেন না
- যা দিয়ে কী করা যাবে তা আপনি এখনো জানেন না
এভাবে ভাগ করে নিলে কোনগুলোকে আপনি আপনার ঘরে জায়গা দেবেন তা বোঝা অনেক সহজ হয়ে যায়।
রিইউজ বা পুনর্ব্যবহার করুন
হোর্ডিং বা জমানোর সমস্যা সমাধান করতে রিইউজ বা পুনর্ব্যবহার করার জুড়ি নেই। যেমন, অনেক সময় ঘরে গ্লাস জার, ক্যান, কৌটা জমে যায়। তখন এগুলো অযথা এলোমেলো ভাবে জমিয়ে না রেখে শুকনো খাবার বা ছোট ছোট নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস; যেমন পেপার ক্লিপ, টুথপিক ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। তবে তার আগে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে ভুলবেন না!
আপসাইকেল বা নতুন কিছু তৈরি
জমিয়ে রাখা জিনিস বর্তমান অবস্থায় ব্যবহারের উপযোগী না থাকলে, আপসাইকেল হতে পারে হোর্ডিং বা জমানোর সমস্যা সমাধান এর এক দারুণ উপায়। আপসাইকেল মানে পুরোনো জিনিস থেকে সৃজনশীলভাবে নতুন কিছু তৈরি করা। অর্থাৎ, এর কার্যকারিতা কোনো উপায়ে বাড়ানো। যেমন, পুরোনো সিডি বা ক্যাসেট থেকে ঘর সাজানোর চমৎকার কিছু আইডিয়া পেয়ে যাবেন পিন্টারেস্টে।
বিক্রি করুন
জমিয়ে রাখা যে জিনিসগুলো পুনর্ব্যবহারের উপযোগী সেসব বিক্রি করে দেয়াও হোর্ডিং বা জমানোর সমস্যা সমাধান এর উপায় হতে পারে। অ্যান্টিক সামগ্রী, ফার্নিচার, পোস্টার, গিফট কার্ড- বিক্রি করার এ তালিকায় থাকতে পারে যেকোনো কিছুই। অব্যবহৃত জিনিসও অনেক সময় জমিয়ে রাখি ঠিকই, কিন্তু তা আর ব্যবহার করা হয়ে ওঠে না। এসব কিছু বিক্রির জন্য অনলাইন মার্কেটপ্লেস হতে পারে অন্যতম একটি মাধ্যম। ইদানিং ফেসবুকেও ‘সেকেন্ড হ্যান্ড সেলিং’ এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। পাশাপাশি যারা রিসাইকেলের সাথে জড়িত তাদের কাছেও এসব বিক্রি করতে পারেন আপনি।
দান করুন বা উপহার দিন
কিছু অব্যবহৃত জিনিসও আমাদের কাছে মূল্যবান স্মৃতিচিহ্ন, এসব ফেলে দেয়া বা কাউকে দিয়ে দেয়ার কথা আমরা ভাবতেই পারি না। তবে সে তালিকা থেকেও কিছু জিনিস আলাদা করে ফেলা জরুরি। কারণ তা নইলে আপনার ঘরে বাড়তেই থাকবে অকারণ স্তূপ। এক্ষেত্রে নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করতে পারেন যে, জিনিসটি আপনার কোনো কাজেই আসছে না,কিন্তু তা সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য হতে পারে সত্যিকারের উপকারী একটি জিনিস।
হোর্ডিং বা জমানোর সমস্যা সমাধান করা খানিকটা জটিলই বটে। যেহেতু মায়ার কারণেই আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জিনিস জমিয়ে রাখি, তাই নিজেকে সেগুলো বিক্রি করতে, দান করতে বা রিসাইকেল করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। তবে গোছানো পদ্ধতিতে এগোলে এর সমাধান করা যায় ও সেটিই আমাদের সবার জন্য উপকারী।