শিল্পী যেমন আলতু করে ছবি আঁকে ঠিক তেমনি সময় আর যত্ন নিয়ে দিনের পর দিন নিখুঁতভাবে ভাস্কর্য তৈরি করে যাচ্ছেন, ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্পের কারিগররা। এই কাঁসা শিল্পের শুরুর গল্প কিছুটা এমন। প্রায় হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই শিল্প বেঁচে আছে আমাদের মাঝে। যদিও বর্তমান অবস্থা কিছুটা শঙ্কার। সেই প্রসঙ্গে নাহয় একটু পর আসা যাক।
কাঁসা-পিতলের ইতিকথা

এই দেশে কাঁসা-পিতলের প্রচলন কখন এবং ঠিক কিভাবে শুরু হয়েছিল তা সঠিক জানা না গেলেও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, যখন নাকি ব্রোঞ্জশিল্প ছিল যখন তখনই নাকি এই কাঁসা শিল্পের শুরু। ১৫৭৬-১৭৫৭ সালে মোগল আমলে উপমহাদেশে এই কাঁসা-পিতলের ব্যবহার শুরু হয়। তখন এসব ধাতু দিয়ে তৈরি করা হতো ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক যা কিনা ব্যবহৃত হতো যুদ্ধের সরঞ্জাম হিসেবে। এরপর এলো ব্রিটিশ শাসন আমল। এই আমলে বাংলার ঘরে ঘরে এই কাঁসা-পিতলের ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। সে সময় শুধু ঢাকার ধামরাই, শিমুলিয়াতে নয় বরং টাঙ্গাইলের কাগমারী, জামালপুরের ইসলামপুর, বগুড়ার শিববাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করে।
ঘুরে দেখা

নিজের চোখে এই সব তৈরি করা দেখতে পারাও যেন কোন উৎসব। একটা অন্যরকম একটা দিন কাটাতে চাইলে, দেখে আসতে পারেন এই ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল শিল্প । ঢাকা থেকে ৪০ কি.মি দূরে অবস্থিত এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প স্থাপনা দেখা বিশাল এক প্রাপ্তি। আর যদি আপনার ধামরাই যাওয়ার প্ল্যান নিকটে না থেকে থাকে সেক্ষেত্রে ঝটপট দেখে নিতে পারেন আমাদের অলিগলি ভ্লগের এই ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল শিল্প নিয়ে বিশেষ এই পর্বটি।
যেভাবে তৈরি করা হয়

কি সুন্দর নিখুঁতভাবে প্রতিটা ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। কতটা মায়া মমতা দিয়ে প্রতিটা ধাপে ধাপে একেকটি ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। মোমের তৈরি মডেলের ওপর প্রথমে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। যখন এই মাটির প্রলেপ শক্ত আকার ধারণ করে তখন দেয়া হয় মোমের প্রলেপ। এরপর মোম গলে ভেতরটা ফাঁপা হয় আর সেখানে গলিত কাঁসা ঢেলে দেয়া হয়। আবারো চলে ঠুকঠাক হাতের ছোঁয়ার নিপুণ কারুকাজ। এরপর ঠাণ্ডা হলে পলিশ করা হয় ‘এন্টিক লুক’ আনার জন্য। এভাবেই তৈরি হয়ে গেল কাঁসা-পিতলের রাধেকৃষ্ণ ও গণেশ ভাস্কর্য। বাংলার এই ভাস্কর্যের চাহিদা ও সুনাম দেশ ছাপিয়ে বিশ্বব্যাপী।
কাঁসা-পিতলের সামগ্রী
ধামরাইয়ের বিখ্যাত রথটি পার হতেই চোখে পরবে কাঁসা-পিতলের নানা দোকান যেখানে ঢুকতেই আপনি বাধ্য হারিয়ে যেতে। দোকানের ভেতরে যখন তালা খুলে প্রবেশ করবেন তখনই আপনার চোখে এসে বিঁধবে সোনালি আলো। এমন মনে হতেই পারে “আমি কি কোন জাদুঘরে আছি না তো”। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর নানা রকম চরিত্র এখানে এসে যেন জীবন পেয়েছে। বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি ছাড়াও নানা ধরনের ভাস্কর্যের সম্ভার রয়েছে এখানে।

সময়ের সাথে ধামরাইয়ের কাঁসা পিতল শিল্প বেশ বদলে গেছে। কাঁসার সামগ্রী ব্যবহার করার মাত্রা কমে গেলেও শৌখিন মানুষের কাছে এর চাহিদা যেন আগের মতই আছে। ঘর সাজানোর উপকরণ হিসেবেও ইদানীং ব্যবহার করা হয় কাঁসা পিতলের সামগ্রী। বাহারি কত কিছু পাওয়া যায়, শোপিস থেকে শুরু করে ওয়াল ম্যাট, টব, বিভিন্ন ধরনের গ্লাস, থালা, বাটি, কাজলদানি, চামচ, হুক্কা, কলস, ঘণ্টা, গামলা, চামচ, বালতি, ডেগ, কড়াই প্রদীপ, বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, সঙ্গীত সাধনার যন্ত্র, খেলনা, আয়নার ফ্রেম ইত্যাদি। শুধু যে এগুলো তৈরি করেই তারা ক্ষান্ত নয়। তাদের থেকে বাদ পরেনি বনের বাঘ, সিংহ, হাতি, ঘোড়া, হরিণ থেকে শুরু করে মাছ, ডলফিন, হাঙর, তিমিসহ বাদ্যযন্ত্রের শোপিস, বিভিন্ন স্থাপনা ও যানবাহনের প্রতিলিপি তৈরি হয় ঘর সাজাতে। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সামগ্রীর মধ্যে ঘণ্টা, কাশি, করতাল, মূর্তি, তুলসীপত্র, পঞ্চপ্রদীপ, পুষ্পথালা, ঘটি, গোলাপ জলের পাত্র, আগরদানিসহ বিভিন্ন তৈজস পাওয়া যায়। থিমভিত্তিক নকশা করা হয় এসব সামগ্রীতে। ফুল-পাতা ও জ্যামিতিক নকশাও হচ্ছে। অ্যান্টিক পণ্য চাইলে পুরনো কোনো পণ্যের নকল তৈরি করে নেওয়া যায় ধামরাইয়ের এই দোকান থেকে।
দরদাম

কাঁসার সামগ্রী ২২০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা কেজি দরে এবং পিতলের সামগ্রী ১৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ওজন ছাড়াও সূক্ষ্ম নকশার ওপর দাম কম-বেশি হতে পারে। এ ছাড়া ফুলদানি ৫০০ থেকে ১২,০০০ টাকা, ফুলের টব ১০০০ টাকা থেকে ২০,০০০ টাকা, টবের স্ট্যান্ড ১০০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা, বাতির শেড ১৫,০০০ টাকা, কলস (হালকা নকশা) ১০০০ টাকা থেকে ৪০০০ টাকা। কলস (ভারি নকশা) ১৫০০ টাকা থেকে ৮০০০ টাকা ও ওয়ালম্যাট ১০০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা। এ ছাড়া আকার, নকশা ও ওজনভেদে বিভিন্ন শৌখিন পণ্য ও শোপিস কিনতে পারবেন ৫০০ থেকে ২০,০০০ টাকায়।
এত সময় দিয়ে যে শিল্পটি আমাদের মাঝে জায়গা করে নিয়েছিল সেই শিল্পটি আজ বিলুপ্তির পথে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে টিকতে পারছে না এই ধামরাইয়ের কাঁসা পিতল শিল্প । ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, এক সময় না জানি কত শত গল্প-গান, প্রেম-বিরহ আর স্মৃতি জড়িয়ে ছিল এই শিল্পটি ঘিরে। হয়তোবা কাঁসা পেটানোর শব্দে একসময় দিন-রাতে মুখর থাকতো এ গ্রাম। সে মুখরতা, আজ মিলিয়ে গেছে।
তবুও, দিনশেষে এই ঐতিহ্য ধরে রাখার দায়িত্ব যেন আমাদেরই। সময় করে একদিন ঘুরে আসতে পারেন ধামরাইয়ের কাঁসা পিতল শিল্পের আস্তানা থেকে। কেমন লাগলো আজকেই এই ভ্লগ জানাতে দেরি করবেন না একদম। এমন আরও সুন্দর সুন্দর ভিডিও পেতে অলিগলির ইউটিউব প্লে লিস্টটি নজরে রাখুন।