Reading Time: 3 minutes

কথায় বলে, ‘বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বণ’। সত্যিই কিন্তু তাই! এখানে গ্রীষ্মের দাবদাহে করা হয় বৈশাখ বরণের আয়োজন, ঝুম বৃষ্টিতে হয় বর্ষা উৎসব, হেমন্তে নতুন ধান ঘরে তোলাকে কেন্দ্র করে পাড়া মেতে ওঠে নবান্ন উৎসবে। শীত আর তবে বাদ যাবে কেন! কুয়াশার চাদর ভেদ করা নরম রোদ কিংবা ঘাসের গায়ে জমে থাকা শিশিরের স্বচ্ছতা, শূণ্য ইউক্যালিপটাসের চূড়ায় বিকেলের কমলা আলো বা বাতাসে হিমের ঘ্রাণ – সবই তো উৎসবের উপলক্ষ, যেন নীরবেই দাবি করে নিজস্ব আয়োজন। চিরন্তন সেই উপলক্ষ কেন্দ্র করে বাংলার গ্রামাঞ্চলে পৌষ পার্বণ আয়োজিত হয়। অন্যান্য উৎসবের মতো এর শহুরে রূপ এখনো তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি, বরং গ্রামগুলোতেই মানুষ সাগ্রহে এই উৎসবটি পালন করে। 

পৌষ পার্বণঃ কী ও কবে? 

পৌষ পার্বণ মূলত শীতের আগমনকেই উদযাপন করে। তবে এর আরেক নাম ‘পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি’। বাংলা মাসের আবর্তনে – প্রতিমাসের শেষ দিন অর্থাৎ যে দিন মাস পূর্ণ হবে সে দিনকে সংক্রান্তি বলা হয়। পৌষ মাসের শেষদিনেই তাই সাধারণত এই উৎসব পালিত হয়। এর আরেক নাম ‘মকর সংক্রান্তি’ হওয়ার কারণটি অবশ্য খানিকটা ভিন্ন। রাশিচক্রের রাশিগুলোও মাস অনুযায়ী আবর্তিত হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। ধারনা করা হয়, বছরের এই সময় মকর রাশির আবর্তন শেষ হয়। 

গ্রামবাংলায় পৌষ পার্বণের আয়োজন 

চুলার পাড়ে উড়ছে ধোঁয়া 

চিতই
নকশি পিঠা, নানা পুরের পুলি পিঠা, পাটিসাপটা, মালপোয়া থেকে শুরু করে বহুল প্রচলিত চিতই, দুধ-চিতই, ভাপা পিঠা- সব তৈরি হয় আমাদের গ্রামবাংলায়

পৌষের শেষ দিকে গ্রামের বউ-ঝিরা উঠোনে দেয় নতুন মাটির প্রলেপ। সদ্য নিকোনো সেই উঠোনে কেউ কেউ চালের গুঁড়া গুলিয়ে আল্পনাও আঁকে। ঢেঁকিঘরে ব্যস্ততা শুরু হয় শেষ রাত থেকেই। সূর্য ওঠার আগেই ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে নতুন চালের গুঁড়ার ঘ্রাণ। রান্নাঘরের ব্যস্ততা তখন আরো বেশি। কেউ নতুন পাটালি গুঁড় দিয়ে ভাপা পিঠা বানাতে ব্যস্ত, কেউ হাঁড়িতে জ্বাল দিচ্ছেন সদ্য সংগৃহীত খেজুরের রস। দেখলে মনে হবে যেন পিঠা-পুলির মেলা বসে গেছে সেখানে। নকশি পিঠা, নানা পুরের পুলি পিঠা, পাটিসাপটা, মালপোয়া থেকে শুরু করে বহুল প্রচলিত চিতই, দুধ-চিতই, ভাপা পিঠা- সব তৈরি হয় আমাদের গ্রামবাংলায়। তবে পৌষ পার্বণের নাস্তা হিসেবে রুটি জাতীয় ছিট পিঠা ও হাঁস ভুনার কথাও শোনা যায়। পৌষ পার্বণের আরো একটি চমৎকার অনুষঙ্গ হলো নলেন গুঁড়ের পায়েস। 

শুধু যে পিঠা বানিয়েই ক্ষান্ত হন গ্রামের মানুষ তা কিন্তু নয়, পাড়াব্যাপী প্রতি বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়া হয় পিঠা। পিঠায় থালা সাজিয়ে এভাবে বাড়িতে বাড়িতে পাঠানোর রেওয়াজ এখনো আমাদের সম্প্রীতি ও আন্তরিকতার অনন্য পরিচায়ক। 

সুরে-তালে-ছন্দে

গ্রামবাংলায়, বিশেষত আদিবাসী গ্রামগুলোতে পৌষ পার্বণ উপলক্ষে নাচ-গানের আয়োজন হয়। এসব সাংস্কৃতিক আয়োজনে নিজস্ব ঐতিহ্যের ছাপ বড় স্পষ্ট। যেমন, মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ধামাই চা-বাগানের বটতলায় চা-শ্রমিকদের দল লাঠিনৃত্য পরিবেশন করে। আবার মানিকগঞ্জে পৌষ পার্বণ উপলক্ষে উদীচি শিল্পী সংঘের আয়োজনে গাওয়া হয় ভাওয়াইয়া, জারি, গাজীর গান ও গম্ভীরা গান। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব পড়ার আগে গ্রামে গ্রামে পৌষ পার্বণ উপলক্ষে যাত্রাপালার আয়োজনও করা হতো। শীতের রাতগুলোতে চাদর-মাফলার মুড়ি দিয়ে গ্রামবাসী বসতো স্টেজের সামনে পেতে রাখা চাটাইয়ে। ঝলমলে পোশাক পরে স্টেজে হাজির হতো চাঁদ সওদাগর বা দেবী মনসা। বাড়ির উঠোনে বসে গ্রাম্য গায়কেরা সুর করে গাইতো, 

“পৌষ মাসে পিঠেপুলি, মহা ধূমধাম,

ঘরে ঘরে পিঠে গড়ে, ধন্য পল্লীগ্রাম।

দুধপুলি, গুড় পিঠে, নারিকেল আর,

সকলে করিছে পিঠে, সকল প্রকার।” 

মেলার মাঠে 

মেলা
গ্রামের মানুষের বিনোদনের এক অন্যতম আকর্ষণ এই পৌষ মেলা

পৌষ পার্বণ উপলক্ষে মেলা আয়োজনের রীতি আছে অনেক গ্রামেই। মাটির জিনিস, শিশুদের খেলনা, হাতে বানানো বেত ও বাঁশের সামগ্রী, প্রসাধনীর পসরা বসে এসব মেলায়। গ্রামের মানুষের বিনোদনের এক অন্যতম আকর্ষণ এই পৌষ মেলা। বাচ্চারা মা-বাবার হাত ধরে মেলা প্রাঙ্গণে ভিড় জমায়। তাদের জন্য অনেক জায়গায়ই থাকে পুতুল নাচ, বায়োস্কোপের আয়োজন। মেলা শেষে ফিরতি মানুষের হাতে প্রায়ই দেখা যায় বাচ্চাদের জন্য কেনা মাটির পুতুল-ফুটবল, স্ত্রী’র জন্য কেনা আলতা-চুড়ি-ফিতা। পৌষ সংক্রান্তিতে আয়োজিত মেলায় পিঠা-পুলি, মুড়ি-মুড়কিও বিক্রি হয়। ইদানিং মফস্বল বা জেলা শহরগুলোতেও এমন মেলা শীত উপলক্ষে আয়োজিত হয়। শুধু তাই নয়, ঢাকার চারুকলাও এমন মেলার আয়োজন করে। গ্রামীণ মেলার ঐতিহ্য ধরে রাখার তাড়না থেকেই এমন আয়োজন করে শিক্ষার্থীরা। 

অগ্রহায়ণে কৃষক ঘরে তোলে নতুন ধান, অর্থাৎ তার সারা বছরের পরিশ্রমের ফসল। সেই ধান তোলার পর তার কিছুদিনের অবসর এই পৌষ মাসেই। সেইসাথে যোগ হয় নতুন পিঠার স্বাদ আর মেলার উৎসবমুখরতা। তাই স্বল্প অবসরের এই সময়টায় গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে হয় পৌষ-পার্বণ। শহুরে উৎসবের মতো এখানে কৃত্তিমতা নেই, নেই ব্যানার-ফেস্টুনের আনুষ্ঠানিকতা। তবে আন্তরিকতা আর ঐতিহ্যের ছাপ এখানে স্পষ্ট, এখানে সব আয়োজন মাটির কাছাকাছি, প্রকৃতির কোলে। 

এজন্যই পৌষ পার্বণকে বলা হয় আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ধারক। গ্রামবাংলার এই উৎসবটি সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে লিখতে পারেন আমাদের কমেন্টস বক্সে।

Write A Comment