Reading Time: 4 minutes

‘গ্রামে কেমন হয় শীত? কেমন ছিলো শীত?’ বহুতল ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে এসবই ভাবছিলাম। নিজের অজান্তেই মন ফিরে গেলো ছায়াঘেরা উঠোনে, সুদূর অতীতে। সেখানে শীতের শুরুতে লেপের ভাঁজ থেকে বেরিয়ে আসে শুকনো নিমপাতার ঘ্রাণ। সেখানে শীতের আয়োজনে জড়িয়ে থাকে মটরশুটি পোড়ানো বিকেল আর ভাপাপিঠার ধোঁয়া। সেখানে বড় যত্নে পাতে তুলে দেয়া হয় লাউ-শোলমাছের তরকারি। সেখানে শীতের সন্ধ্যায় নিস্তরঙ্গ জলাবনে ডানা ঝাঁপটায় বুনোহাঁসের দল। কুয়াশা আর হিমে ঘেরা কাব্যের অন্তরালেও এক অন্যভুবনের কথা বলে গ্রামীণ জীবনে শীতকাল। তেমন কিছু কথা নিয়েই লিখছি এই ব্লগ! 

শীতবুড়ি এলো রে

খেজুর গাছ
সূর্য ওঠার আগেই তা সংগ্রহের জন্য গাছে উঠে যেতেন গাছিরা

ছোটবেলায় কোনো এক সাপ্তাহিক সাময়িকীতে পড়েছিলাম ‘দাদুভাই’ নামে বেশি পরিচিত ছড়াকার রফিকুল হকের লেখা, 

“কাঁপা ঠকঠক বকা বকবক

থুরি!

তোর নাম আরে

শীতকাল না-রে বুড়ি?” 

তাই বোধহয় শৈশবে যতবার গ্রামে শীতের সকাল দেখার সুযোগ হয়েছে, মনে হয়েছে এই হাড়কাঁপানো শীত জবুথবু এক বুড়িরই কীর্তি! শহরের মতো সেখানে ধোঁয়া আর কুয়াশা মিলে ‘ধোঁয়াশা’ জমাট বাঁধে না। বরং গ্রামকে পরম মমতায় জড়িয়ে রাখে গাঁঢ়, নিশ্ছিদ্র কুয়াশার চাদর। আধো অন্ধকার সেই শীতে সূর্যিমামার দেখা পাওয়াই দায়। টুপটাপ শিশির ঝরে পড়ার শব্দ পাওয়া যায় টিনের চালে। পুকুরের পানি জমে সেখানে পশ্চিমা দেশের মতো বরফ হয় না ঠিকই, তবে শীতের সকালে স্থবির চেহারার পুকুর যারা দেখেছেন; তারা জানেন এ দেশীয় শীতের এক অনন্য উপাদান সেই দৃশ্য। 

নটা-দশটা পেরোলে সূর্য আলো ছড়ায়। শিশিরভেজা ঘাস সেই আলোতে চকচক করে ওঠে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামার আগেই সন্ধ্যা নামে গ্রামে। শীতের আগমনে এমনিতেই ব্যাপ্তি কমে দিনের, তবে গ্রামের বাড়ির উঠোনে বসে তা যেন আরো স্পষ্ট ভাবে উপলব্ধি করা যায়। রিক্ততার সৌন্দর্য গ্রামের শীতের অন্যতম অনুষঙ্গ। শীতকালে চিরাচরিত সবুজ প্রকৃতির দেখা মেলে না গ্রামে। বরং শূণ্য ডালপালা আর উঠোনে জমে থাকা শুকনো ডালপালা শীতকে ফুটিয়ে তোলে স্বমহিমায়। শূণ্যের মাঝে ছড়িয়ে থাকা এই অনন্য সৌন্দর্যের কথা ভেবেই হয়তো পল্লীকবি লিখেছিলেন, “শীতের তাপসী কারে বা স্মরিছে আভরণ গার খুলি?” সত্যিই তো শীতকালে গ্রামীণ প্রকৃতি নিরাভরণ! 

আজকাল গ্রামের প্রকৃতিতেও লেগেছে নাগরিক জীবনের ছোঁয়া, আধুনিকতার সর্বগ্রাসী স্পর্শ। তবু যখন শীতের প্রকোপে ঘুমিয়ে থাকা গ্রামীন জনপদে ভোর হয়, কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতি আর শুকনো পাতার ঝরে পড়ার শব্দে স্মরিত হয় ফেলে আসা সব শীতের সকালের স্মৃতি। 

চুলার পাড়ে

চিতই
গ্রামের রান্নাঘর মুখরিত হয় চিতইয়ের ঘ্রাণে

গ্রামীণ জীবনে শীতকাল মানেই চুলার পাড়ে যেন জমে ওঠে উৎসব। নতুন চালের গুঁড়ো আর সদ্য সংগৃহীত খেজুরের রসের ঘ্রাণে মুখরিত হয় ঘর-আঙ্গিনা-চৌকাঠ। মা-চাচীরা যেন আদরের মূর্তিমান রূপ হিসেবে তৈরি করেন হাতে বানানো সেমাই, নকশি পিঠা। মনে পড়ে শীতের ভোরে মাটির চুলার পাশে বসে কী প্রগাঢ় ভালোবাসায় ভাপাপিঠা জোড়া লাগানোর চেষ্টা করতেন দাদী-নানীরা! দুধ চিতই ভেজাবেন বলে শীতের প্রাবল্য উপেক্ষা করেই ভোররাতে রান্নাঘরে চলে যেতেন তারা। 

শুধু পিঠাপুলিই তো নয়, রসনাবিলাসের আরো কত আয়োজন শীতকে ঘিরে। সন্ধ্যাবেলা রসের হাড়ি ঝুলিয়ে দেয়া হতো খেজুর গাছে। সূর্য ওঠার আগেই তা সংগ্রহের জন্য গাছে উঠে যেতেন গাছিরা। প্রাতঃরাশে বড় গ্লাসে করে খেতে হতো সেই খেজুরের রস। কেউ কেউ চলে যেতেন চরাঞ্চলে। শীতে সেখানে অতিথি পাখি আর বুনোহাঁসের সমাগম হতো। ঘরে পালা রাজহাঁসও শীতের খাবারের তালিকায় ছিলো অন্যতম। আর ছিলো শীতের সবজি। ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, লাউয়ের নিরামিষ বা সারা রাত জাল ফেলে রেখে পাওয়া ছোটমাছের চচ্চড়ির স্বাদ যেন দ্বিগুণ হতো শীতে। 

এখন আর হয়তো গ্রামে রান্না হয়না মাটির চুলায়। তবে শহরের সাথে তুলনা করলে সেখানে এখনও শীতের খাবার মানে ঢের টাটকা খাবারের সমারোহ। হাতে বানানো সেমাই বা গাছিদের দেখা হয়তো এখন আর মিলবে না বাংলার গ্রামগুলোতে, তবু এখনো গ্রামের রান্নাঘরগুলোতে উঁকি দিয়ে দেখতে পারেন। পরম মমতায় শহুরে নাতি-নাতনীদের জন্য হয়তো চিতই বা পুলিপিঠা বানাচ্ছেন অশীতিপর কোনো বৃদ্ধা। 

আমন্ত্রণে-নিমন্ত্রণে

গ্রামীণ জীবনে শীতকাল মানে ‘নাইওর’ আর ‘কুটুম্বকাল’। আঞ্চলিক ভাষায় এভাবেই শীতকে আখ্যায়িত করা হয় আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণের ঋতু হিসেবে। এসময় বউরা মায়ের বাড়িতে ছুটি কাটাতে যান, শহুরে সন্তানেরা ফেরেন ফেলে আসা গ্রামের কোলে। আপ্যায়নের সবচেয়ে দারুণ চিত্র তাই এ সময়ই ফুটে ওঠে গ্রামে।

গ্রামের উঠোনে বহুদিন পর জমে ওঠে আড্ডা। বহুদিন পর্যন্ত দেখেছি শীতের ছুটি মানেই চাচাতো-ফুপাতো বা মামাতো-খালাতো ভাইবোনদের একত্র হওয়ার সুযোগ। সেইসব শীতকালের সকালে সারি বেঁধে টানা বারান্দায় বসতো কচিকাঁচার দল। খেজুরের রসে ভিজিয়ে টপাটপ চিতই খাওয়ার সকাল ছিলো তখন। দুপুরে বড়রা যখন ভাতঘুম দিতে ব্যস্ত, তখন সোয়েটার-টুপিতে নাকমুখ ঢেকে চড়ুইভাতির পরিকল্পনা করতো কিশোর-কিশোরীর দল। এ ঘর থেকে দু মুঠো চাল, ও ঘর থেকে দুটো মুরগি- ব্যাস! এই নিয়েই হাতে বানানো মাটির চুলায় রান্না চাপানো হতো সন্ধ্যায়। কুপিবাতি আর হ্যারিকেনের আলোয় আলোকিত গ্রামের সেসব সন্ধ্যায় জমতো ভূতের গল্পের আসর। পানের বাক্স হাতে নিয়ে হয়তো সেসব আসরের মধ্যমণি হতেন বুড়ো দাদী। তাকে ঘিরে থাকতো নাতি-নাতনীর দল, মেছোভূতের নাকি সুরের ডাক কল্পনা করে বা শীতের প্রাবল্যে লেপের নিচে বসেও ঠকঠক করে কাঁপতো তারা। 

ইদানিং বেড়েছে ব্যস্ততা, আধুনিক জীবনে বড় বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা। তাই একসাথে দলবেঁধে গ্রামে যাওয়ার ফুরসত মেলে না আমাদের অনেকেরই। হুটহাট ছুটি পেলেও বাড়ির ছাদে বারবিকিউ বা একদিনের পিকনিকেই তা ফুরিয়ে যায়। তবু শত ব্যস্ততার বাঁধন এড়িয়ে যারা এখনো গ্রামে ছুটে যাবার সুযোগ পান, তারা হয়তো কিছুক্ষণের জন্য হলেও ফিরে পান ফেলে আসা শীতের চড়ুইভাতি আর  আন্তরিক আপ্যায়নের স্বাদ। 

শীতঘুম অভিমান 

গ্রামীণ জীবনে শীতকাল এর কত রকমারি আয়োজন হয় তা তো বললাম, তবে শীত কেমন বিপর্যস্ত করে গ্রামবাসীকে সেটা না বললে আর গ্রামীণ শীতের পুরো ছবি আঁকা হয়ে উঠবে না। গ্রামে নেই ইলেকট্রিক হিটারের উষ্ণতা, নেই পশমি কম্বলের কোমলতা বা ভ্যাজলিন-গ্লিসারিনের যত্নে রাখার প্রতিশ্রুতি। অথচ শীতের রুক্ষতম ও তীব্রতম রূপের উপস্থিতি আদতে সেখানেই! হাতে বোনা শাল-মাফলারে শীত কাটায় গ্রামের মানুষ। কম্বল আর ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ নয়, বরং শিমুল তুলার লেপ আর নিমপাতার ঘ্রাণ গ্রামবাসীর শীতকালীন সারথি। শীত তাড়াতে আগুনে হাত সেঁকে নেন তারা, ঘরের কোণে রাখেন কুপিবাতি বা প্রজ্বলিত কয়লার টুকরা। গ্রামীণ জনপদের বেশিরভাগই যেহেতু শ্রমজীবী মানুষ, দারিদ্র্যের প্রকোপ যেহেতু তাদের নিত্যসঙ্গী; তাই প্রবল শীতেও হাটে-মাঠে-ঘাটে ছুটে যেতে হয় তাদের। গ্রামের শীতের সকালে তাই অতি পরিচিত দৃশ্য- কুয়াশার মাঝেই খেতের আইল ধরে হেঁটে যাচ্ছেন কলিমুদ্দি মাঝি বা জেলেপাড়ার হাসান। 

আগেই বলেছি, পরিবর্তনের প্রাবল্যে স্বীয় রূপ হারাচ্ছে গ্রামবাংলা। তাই এখন হয়তো কিছু স্বচ্ছল ঘরে শীত নিবারিত হয় কম্বলের ওমে, বাজার থেকেই কিনে আনা হয় শীতের কাপড়। তবে শীতের কবলে দরিদ্র মানুষের যে নিদারুণ কষ্টের রূপ তা আজও গ্রামে বড্ড বেশি স্পষ্ট। আজও টিকে থাকার লড়াই করতে শীত উপেক্ষা করে ছুটতে হয় কলিমুদ্দি ও হাসানকে। হয়তো বদলেছে তাদের পেশা বা জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম। কলিমুদ্দি হয়তো বৈঠার বদলে হাতে তুলে নিয়েছে ইঞ্জিনের সুইচ, হাসান হয়তো ভাবছে কারেন্ট জালে মাছ ধরার কথা। কিন্তু কুয়াশাঘেরা সকালে ফাটা পা নিয়েই জমির আইল ধরে ছুটছেন তারা। 

শামসুর রাহমান গ্রামের শীতকে বলেছেন ‘তপস্যারত ঋষি’। কবি ভুল বলেননি, শীতের রিক্ত বসন আর স্থবির প্রকৃতি তো ধ্যানের কথাই মনে করায়! বহু কিছু বদলে গেছে, বহু কিছু হারিয়েছে কালের গহ্বরে বা আধুনিকতার অন্তরালে। তবু গ্রামীণ জীবনে শীতকাল এর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে আশৈশব জমানো স্মৃতিরা, আজীবন ধরে জমানো স্নেহমাখা সুর।

Write A Comment