Reading Time: 3 minutes

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন বা পার্লামেন্ট ভবন অবস্থিত ঢাকার শেরে বাংলা নগরে। ঢাকা শহরে কিংবা ঢাকার বাইরে যেখানেই থাকা হোক না কেন, সংসদ ভবন এরিয়ার আশেপাশে দিয়ে হাঁটা হয়নি বা যাতায়াতের সময় এ রাস্তা ব্যবহার করেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কিছুটা কঠিনই বলা যায়। চমৎকার এই স্থাপনাটি আমাদের দেশের তো বটেই, বিশ্বের আকর্ষণীয় স্থাপনার মধ্যে অন্যতম একটি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সংসদ ভবনটিও এই দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশের সকল সংসদীয় কার্যক্রম মূলত এই ভবন থেকেই পরিচালনা করা হয়। আর এ কারণেই এটি স্থাপন করার সময় বিশেষভাবে এ ভবনের নকশা করা হয়।

নির্মাণের পরিকল্পনা 

সংসদ ভবন এরিয়ার লেক

ঢাকাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী হিসাবে ঘোষণা দেয়ার পর ১৯৫৯ সালে শেরে-বাংলা নগরে একটি সংসদ ভবন তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। তৎকালীন সময়ের খ্যাতনামা মার্কিন স্থপতি লুইস কানকে ভবনটির নকশা তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৬২ সালের দিকে কান ভবনটির নকশা সরকারের কাছে জমা দেন। নকশা অনুসারে ভবনটি তৈরির জন্য ১৯৬৪ সালে ১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার অনুমোদন করা হয়। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এর নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখা হয়। ১৯৭৪ সালের দিকে মূল পরিকল্পনা অনুসারে কাজটি পুনরায় শুরু করা হয়। তবে ১৯৭৪ সালে লুইস কান মৃত্যুবরণ করলে এর কাজে আবারো বাধা পড়ে।   

লুইস কানের মৃত্যুর পর প্রকৌশলী মাজহারুল ইসলাম এর উপর জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণের অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব পড়ে। আর এই ভবনটিকে কেন্দ্র করে আশেপাশে রাখা হয় সুপ্রিম কোর্ট, মসজিদ এবং রাষ্ট্রপতির বাসভবন। চমৎকার এই স্থাপনার নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৮২ সালে। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার সে সময় এটি উদ্বোধন করেন। নির্মাণের কাজটি সম্পন্ন করতে শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল ৩ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। জানুয়ারি মাসে এর কাজ শুরু হলেও ১৯৮২ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি মাসে এই ভবনে প্রথমবারের মতো সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

স্থাপত্য ডিজাইন 

জাজাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্স

মূল ভবনটি তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত। এই ভাগগুলো হলো- প্রধান প্লাজা, দক্ষিণ প্লাজা ও প্রেসিডেন্সিয়াল প্লাজা। এই ভাগগুলোতে রয়েছে নয়টি আলাদা বিভাগ। এর ভিতরে ৮টির উচ্চতা ৩৩.৫৩ মিটার। মূল ভবনটির উচ্চতা ৪৭.২৪ মিটার। ভবনটি ঘিরে রয়েছে একটি কৃত্রিম হ্রদ, যেটা দেখলে মনে হয়, পুরো ভবনটি যেন পানির উপর ভেসে রয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রতীক হিসাবেই লুই কান মূলত নকশায় এই হ্রদ যুক্ত করেছিলেন।

ভবনের ভেতরে প্রাকৃতিক আলো প্রবেশের জন্য তিনি নকশায় বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছেন। তিনি এই ভবনে বৃত্ত, অর্ধবৃত্ত, বর্গ, ত্রিভুজের কাঠামোগুলো দিয়ে একটি অসাধারণ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। যেখানে ভবনের তিনি কোনো সরল খুঁটি রাখেননি। কেননা ভবনের ভর সঞ্চলানের জন্য খুঁটিগুলিকে তিনি জ্যামিতিক নকশায় এমনভাবে স্থাপন করেছেন, যা দেখলে মনে হয় পুরো ভবনের কক্ষগুলো কোন খুঁটি ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছে।

কমপ্লেক্স এরিয়া 

জাজাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্স

জাতীয় সংসদ ভবনের মূল ভবনটি তিন ভাগে বিভক্ত। মূল ভবনটি কমপ্লেক্সের কেন্দ্রে অবস্থিত। এমপি হোস্টেল এবং জরুরী কাজে ব্যবহৃত ভবনসমূহ কমপ্লেক্সের বহির্ভাগে অবস্থিত। মূল ভবনের আশপাশ জুড়ে রয়েছে কৃত্রিম হ্রদ। 

মূল ভবনের নকশা

সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের মূল ভবনটি নয়টি পৃথক ব্লক দিয়ে তৈরি। মাঝের দিকের অষ্টভূজ ব্লকের উচ্চতা ১৫৫ ফুট এবং বাকি আটটি ব্লকের উচ্চতা ১১০ ফুট। একেকটি ব্লক একেক ধরনের কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। যদিও করিডোর, লিফট, সিঁড়ি ও বৃত্তাকার পথ দিয়ে একটি ব্লকের সাথে আরেকটি ব্লক যুক্ত রয়েছে।  

প্রধান প্লাজা

জাতীয় সংসদ ভবন এর প্রধান প্লাজার মূল অংশেই রয়েছে সংসদ অধিবেশনের কক্ষ। এখানে একই সময়ে ৩৫৪ জন সদস্যের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। ভিআইপিদের বসার জন্য দুইটি প্ল্যাটফর্ম এবং দুইটি গ্যালারী রয়েছে। উচ্চতার দিক দিয়ে এই কক্ষটি ১১৭ ফুট। কক্ষের ছাদটি এমন স্বচ্ছভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন দিনের আলো সহজে এর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। লুই কানের স্থাপত্য ক্ষমতার উল্লেখযোগ্য একটি দিকই হচ্ছে সূর্যের আলো প্রবেশের বিশেষ এই নকশা।   

এছাড়া প্রধান প্লাজার উপরের অংশে আরও রয়েছে অতিথিদের জন্য বসার জায়গা এবং গণমাধ্যমের জন্য গ্যালারীর ব্যবস্থা। এছাড়াও আছে- একটি গ্রন্থাগার, সংসদ সদস্যদের জন্য লাউঞ্জ এবং মিলনায়তন। 

প্রধান প্লাজা: ৮২৩,০০০ বর্গফুট (৭৬,০০০ বর্গমিটার)

দক্ষিণ প্লাজা

মানিক মিয়া এভিনিউ এর দিকে সংসদ ভবনের যে অংশটি দেখা যায় তা মূলত সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা। সংসদের অধিবেশন চলাকালীন সময়ে এই অংশটি সংসদ ভবনের মূল প্রবেশ পথ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ২০ ফুট উচ্চতার এই ভবনটিতে আরো আছে- নিয়ন্ত্রিত প্রবেশপথ, ড্রাইভওয়ে, প্রধান যন্ত্র প্রকৌশল এর কক্ষ, গাড়ি পার্কিং-এর জন্য বিশাল জায়গা, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, রক্ষনাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলীদের অফিস রুম, উপকরণ সরঞ্জাম রাখার জায়গা এবং মূল ভবনে যাওয়ার জন্য খোলা চত্বর। 

দক্ষিণ প্লাজা: ২২৩,০০০ বর্গফুট (২১,০০০ বর্গমিটার)

প্রেসিডেন্সিয়াল প্লাজা

প্রেসিডেন্সিয়াল প্লাজার সামনের দিকে লেক রোড অবস্থিত। এই প্লাজাটি মূলত সংসদ সদস্য এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই প্লাজার ভেতরে রয়েছে মার্বেলের তৈরি মেঝে, গ্যালারী এবং প্রশস্থ পথ। 

প্রেসিডেন্সিয়াল প্লাজা: ৬৫,০০০ বর্গফুট (৬,০০০ বর্গমিটার)

স্থাপত্য ডিজাইন এর দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি স্থাপনা জাতীয় সংসদ ভবন । নান্দনিক এই ভবনের সৌন্দর্য শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মধ্যে একটি হিসেবে তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।   

Write A Comment

Author