নগরায়নের প্রথম ধাপেই নির্মিত হয় সড়ক। কারণ যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থা শহরের প্রাণ। খেয়াল করলে দেখবেন, ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়ক যে এলাকাগুলোয় রয়েছে সেগুলো বেশ উন্নত। অর্থাৎ শহরের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক বড় ধরনের প্রভাবক সড়কগুলো। এই সিরিজের প্রথম অংশে আমরা মিরপুর রোড, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ সহ বেশ কিছু প্রধান সড়ক সম্পর্কে জেনেছি। আজকের ব্লগে থাকছে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ আরো কয়েকটি সড়কের কথা।
বেগম রোকেয়া সরণি
মিরপুরের গুরুত্বপূর্ণ দুটো অ্যাভিনিউয়ের মধ্যে বেগম রোকেয়া সরণি একটি, আরেকটি হলো মিরপুর রোড। মিরপুরকে পুরো শহরের সাথে সংযুক্ত করেছে এ দুটো সড়কই। তবে এদের মাঝে কিছু পার্থক্যও রয়েছে। মিরপুর রোড মূলত বাইরের দিক থেকে মিরপুরকে অন্যান্য এলাকার সাথে যুক্ত করেছে কিন্তু রোকেয়া সরণির বিস্তার মিরপুরের প্রধান অংশগুলোর মাঝখান দিয়ে। অর্থাৎ আগারগাঁও, তালতলা, শ্যাওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, মণিপুর, সেকশন ১০, সেকশন ৬, সেকশন ৭, সেকশন ১১, পল্লবী, মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট এবং মিরপুর ডিওএইচএস এলাকাগুলোর ভেতর দিয়ে রোকেয়া সরণির বিস্তৃতি। ঢাকাবাসীর বিশাল এক অংশ এ এলাকায় ও এর আশেপাশে বাস করে এবং বেগম রোকেয়া সরণি ধরেই তাদের নিত্য যাতায়াত। তাই ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়ক এর তালিকায় এর নাম আসবেই।
এ রাস্তায় চন্দ্রিমা উদ্যান, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনফারেন্স সেন্টার (বিআইসিসি), আইডিবি ভবন, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জাদুঘর এবং মিরপুর ১০ গোলচত্ত্বরের মতো শহরের বেশ কিছু পরিচিত ল্যান্ডমার্ক রয়েছে। অনেকগুলো কর্পোরেট অফিস, ব্যাংক, হাসপাতাল, রেস্টুরেন্ট, শোরুম, ব্র্যান্ড আউটলেট, সুপারশপ এবং রেডিমেড গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিও এখানে গড়ে উঠেছে। বেগম রোকেয়া সরণি ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোর মধ্যেও অন্যতম। ঢাকা মেট্রোরেল প্রজেক্টের এমআরটি লাইন-৬ এ রাস্তা ধরেই এগোবে এবং এখানে অনেকগুলো স্টপেজও নির্মিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে, বেগম রোকেয়া সরণি শহরের যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। প্রতিদিন লাখো নগরবাসীর চলাচলের মাধ্যম হয়ে এটি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়ক গুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে।
হাতিরঝিল রোড
হাতিরঝিল প্রজেক্ট হওয়ার আগে গুলশান-বনানী এলাকায় যাতায়াত মানেই ছিলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যাম। তখন গুলশান-বনানী আর সেন্ট্রাল ঢাকা যে হাতিরঝিল দিয়ে সংযুক্ত ছিলো, তা মূলত কিছু বস্তি ও পরিত্যক্ত লেকের একাংশ। তাই ঢাকার এ দু’অংশের সংযোগ সড়ক হিসেবে নির্মিত হয় হাতিরঝিল রোড। সেইসাথে পরিত্যক্ত হাতিরঝিল লেকটিও হয়ে ওঠে ঢাকার সবচেয়ে নান্দনিক জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। ঢাকাবাসীর নিত্যদিনের যাতায়াতকে দ্রুততর করতে হাতিরঝিল রোড রেখেছে অনবদ্য ভূমিকা। শুধুমাত্র এ কারণেই হাতিরঝিল রোডকে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়ক গুলোর তালিকায় স্থান দেয়া যায়। তবে হাতিরঝিল রোডের আরো কিছু সুবিধা রয়েছে।
প্রথমত, এ শহরের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তার মধ্যে একটি সবুজে ঘেরা হাতিরঝিল। দুধারের গাছপালা আর সবুজ গুল্মে ছাওয়া ফুটপাতগুলো মিলিয়ে ইটকাঠের নগরীর মাঝখানে প্রকৃতির সান্নিধ্য এনে দিয়েছে এ সড়কটি। হাতিরঝিল লেকের তীরেও মিলবে সবুজের ছোঁয়া, বিশ্রামের জন্য রয়েছে কিছু বেঞ্চও। নিয়মিত যারা জগিং করেন ও হাঁটতে ভালোবাসেন, তাদের কাছেও হাতিরঝিলের ফুটপাত বেশ আকর্ষণীয়। রাতেরবেলা এর সৌন্দর্য আবার অন্যরকম। ব্রিজগুলোতে রঙ্গিন আলোকসজ্জা আর লেকের পানিতে সেগুলোর প্রতিচ্ছবি মিলে ভীষণ মনকাড়া দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। হাতিরঝিলের আরো একটি সুবিধা হলো এর নিজস্ব যাতায়াত ব্যবস্থা। হাতিরঝিল চক্রাকার বাস সার্ভিস দ্রুত ও সহজ যাতায়াতের ক্ষেত্রকে আরো অনেকটুকু সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়া হাতিরঝিল ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিসও রয়েছে, যা দ্রুত যাতায়াতের পাশাপাশি লেকের মনকাড়া সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগও দেবে আপনাকে। ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিসের পোর্টগুলো রামপুরা, গুদারাঘাট, পুলিশ প্লাজা ও কাওরান বাজার এলাকায়। ঢাকার সেন্ট্রাল অংশে যাতায়াতকে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে সহজ করে তুলেছে হাতিরঝিল রোড।
ডিআইটি রোড- প্রগতি সরণি
শহরের দীর্ঘতম রাস্তাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম ডিআইটি রোড- প্রগতি সরণি। প্রায় ৯ কিলোমিটার লম্বা এ রাস্তার দুপাশে বৈচিত্রপূর্ণ বেশ কিছু এলাকার দেখা মিলবে। মৌচাক মোড় থেকে শুরু হয়ে ডিআইটি রোড- প্রগতি সরণি বিস্তৃত হয়েছে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত। গুলশান-বারিধারা-বসুন্ধরা-উত্তরায় তো বটেই, এমনকি উল্টোদিকে পল্টন এবং মতিঝিলেও যাতায়াতকে সহজ করেছে এ সড়কটি। মূলত সিদ্ধেশ্বরী থেকে খিলগাঁও, রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা, গুলশান, বারিধারা হয়ে বসুন্ধরায় গিয়ে শেষ হয়েছেডিআইটি রোড- প্রগতি সরণি।
বাংলাদেশ টেলিভিশন হেডকোয়ার্টার, হাতিরঝিল, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস, যমুনা ফিউচার পার্কের মতো পরিচিত কিছু ল্যান্ডমার্ক রয়েছে এ সড়কে। এগুলো ছাড়াও বেশ অনেকগুয়লো ব্যাংক, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল, হাসপাতাল, হোটেল, কর্পোরেট অফিস, শোরুম, সুপার শপ, ব্র্যান্ড আউটলেট, ওয়্যারহাউজ এবং ওয়ার্কশপের দেখা মেলে এ রাস্তা ধরে এগুলে। বাড্ডা, গুলশানের মতো বাণিজ্যিক এলাকাগুলোকে পূর্ব ঢাকার আবাসিক এলাকা যেমন রামপুরা, বনশ্রী, মগবাজার, শান্তিনগরের সাথে সংযুক্ত করে ডিআইটি রোড- প্রগতি সরণি। তাই এ কথা বলাই যায় যে, ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হিসেবে ডিআইটি রোড- প্রগতি সরণি উল্লেখযোগ্য এক নাম।
ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে
দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব থেকে ঢাকায় আগত যানবাহনগুলো এ পথেই শহরে প্রবেশ করে। মহাখালী রেলগেট থেকে শুরু হয়ে ময়মনসিংহ পর্যন্ত চলে যায় এ সড়ক। এ ব্লগে অবশ্য আমরা ঢাকার ভেতরে এর যে অংশটুকু পড়েছে সেটির কথা বলছি। শহরের মাঝে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করায় এর ভূমিকা রয়েছে, তবে উত্তরাবাসীর যাতায়াতে এটি সবচেয়ে জরুরি। মহাখালী, বনানী, ক্যান্টনমেন্ট, কুড়িল ও নিকুন্জ এলাকায় যাওয়া আসার ক্ষেত্রেও সড়কটি গুরুত্বপূর্ণ। আর ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের বহুল পরিচিত ও গুরুত্ববহ ল্যান্ডমার্ক হলো রাজধানীর একমাত্র বিমানবন্দর, হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
আর্মি স্টেডিয়াম, কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব, আর্মি গলফ কেলাব ও র্যাব হেডকোয়ার্টার এ সড়ক ধরে এগোলেই চোখে পড়ে। গাজীপুর গামী বাসগুলোর রুটও এ হাইওয়ে। রেডিমেড গার্মেন্টসগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই গাজীপুরে অবস্থিত হওয়ায় এ সেক্টরের জন্যও সড়কটি জরুরি। এছাড়া অসংখ্য ব্যাংক, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল, কর্পোরেট অফিস- সব মিলিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে বেশ প্রাণবন্ত। তবে এখানে ভয়াবহ ট্র্যাফিক জ্যামও হয় নিয়মিত। এজন্যই মিরপুর-এয়ারপোর্ট রোডের ফ্লাইওভারটি নির্মিত হয়। ঢাকা মেট্রোরেল প্রজেক্টের এমআরটি লাইন-২ ও এমআরটি লাইন-৬ এ সড়কে হওয়ায় জযাম কমাতে খানিকটা ভূমিকা রাখবে। বিমানবন্দরের সাথে যাতায়াত ও শহরের সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সত্যিই দারুণ দরকারি এ সড়কটি।
ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়ক নিয়ে এ সিরিজটির দ্বিতীয় পর্বের সমাপ্তি এখানেই। কোনো সড়কের কথা যদি আমরা লিখতে ভুলে গিয়ে থাকি, সেটি কিন্তু আমাদের কমেন্টে জানাতে একদম ভুলবেন না!