Reading Time: 3 minutes

সংবিধান অনুযায়ী, দেশের সব মানুষ সমান। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বাসস্থান বা পেশাগত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য না করাই আমাদের জাতীয় আইন। কিন্তু বাস্তব চিত্র অনেকাংশেই ভিন্ন। আমাদের দেশে এখনো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা চরম অবহেলা ও অসমতার শিকার। এই অসমতার এক নিদারুণ উদাহরণ হলো, বাংলাদেশের উত্তরাধিকার আইন এখনো নারী-পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে তারা সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে পারে না। পরিবর্তন আসছে এই আইনে, কেননা লিঙ্গভেদে এই অহেতুক অসমতার উল্টোপথে বইতে শুরু করেছে সাম্যের হাওয়া। তৃতীয় লিঙ্গের জন্য উত্তরাধিকার আইন পাশ ও কার্যকর হলে কী পরিবর্তন ঘটবে তা নিয়েই আমাদের আজকের ব্লগ। 

বাধা কোথায়? 

মোমবাতি
সমাজে প্রচলিত নানা কুসংস্কার ও অনুদার মানসিকতার কারণে ভাগ্য বিড়ম্বিত জনগোষ্ঠী হিসেবে জীবন যাপন করছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা

সরকার ২০১৩ সালে হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের ভোটাধিকারও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও সমাজে তাদের অবস্থানের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সমাজে তারা প্রতিনিয়ত তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়। নিজ পরিবারেও তারা অচ্ছুত ও অনাদৃত। বেশির ভাগ হিজড়াই কোনো সম্মানজনক জীবিকায় নেই। অর্থাৎ ভাগ্যবিড়ম্বিত জনগোষ্ঠী হিসেবেই জীবন যাপন করছেন তারা। 

বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় জয়া শিকদারের কথা। তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষটি লিঙ্গবৈষম্যের কারণে বাবা-মায়ের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তার এক ভাই এবং দুই বোন মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী সম্পত্তির ভাগ পেয়েছেন। কিন্তু তার ক্ষেত্রে বাধা কী ছিলো তা জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, “আমার বাবা আমাকে বলে, তুমি নারী পরিচয়ে বা নারীর পোশাক পরে আমার কাছে সম্পত্তি নিবা, সেটা আমার সমাজ গ্রহণ করবে না।” এছাড়া মানবাধিকার সংস্থা ব্লাস্ট এর হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার সম্পর্কিত বিভাগে কর্মরত শোভা সরকার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, পরিবারের সম্পত্তিতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কোনো অধিকারই নেই। সম্পত্তির ভাগ চাইলে অনেকসময় ভাই বোনেরাই মারধর করেন। তখন নিরাপত্তার অভাবে অনেকে সম্পত্তির দাবি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের পারিবারিক সম্পত্তির ভাগাভাগির ক্ষেত্রে দেশটির প্রেক্ষাপট মিলিয়ে তাদের স্ব স্ব ধর্মের আইন ব্যবহার হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মের মানুষের সম্পত্তি ভাগাভাগি হয় মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের আওতায়। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেছেন, “মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সন্তানদের কথা বলা হয়েছে। সন্তান মানে পুত্র এবং কন্যারা সম্পত্তির ভাগ পাবেন। বাংলাদেশে বিদ্যমান এই আইনে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যাপারে সুস্পষ্ট করে বলা নাই।”

এ বিষয়ে হিন্দু আইনের ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী বলেছেন, “হিন্দু আইনে হিজড়া সন্তানদের বাবা মায়ের সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার ব্যাপারে কিছু নেই। বিষয়টাতে আলোচনা প্রয়োজন।” দুজন আইনজীবীই আইনের অস্পষ্টতাকে বড় সমস্যা হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

তৃতীয় লিঙ্গের জন্য উত্তরাধিকার আইনঃ সাম্যের পথে 

আইন
আইন যেমন বাস্তবায়িত হওয়া জরুরি, তেমনি বদলাতে হবে আমাদের মানসিকতাও

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা যেন বাবা-মায়ের সম্পত্তি থেকে সমান ভাগ পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে মন্ত্রীসভার বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে কাজ করতে গত ৯ নভেম্বর নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বার্তাসংস্থা এএফপিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, ‘‘আমরা ইসলামিক শরিয়া আইন এবং আমাদের সংবিধান অনুসারে একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছি৷ এর ফলে কোনো পরিবারের তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যের সম্পত্তির অধিকারও নিশ্চিত হবে৷’’ এখনও এই বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়নি, তবে একবার উত্থাপিত হলে তা সহজেই পাস হয়ে আইনে পরিণত হবে বলে আশা করা হচ্ছে৷

তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিতে বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ৷ ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পুরুষ এবং নারীর বাইরে আলাদা লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়৷ গত বছর থেকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ভোটার তালিকাতেও নাম লেখাতে পারছেন তারা৷ এ মাসের শুরুতেই এখানে বেসরকারি উদ্যোগে প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের একটি মাদ্রাসাও চালু হয়েছে৷

তৃতীয় লিঙ্গের জন্য উত্তরাধিকার আইন পাশ ও প্রয়োগ হলে যে সম্ভাব্য ইতিবাচক পরিবর্তনের আশা আমরা করতে পারি তা হলোঃ 

বর্তমানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। সম্মানজনক জীবিকা বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের যে সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয়, তা অনেকাংশেই কমে যাবে যদি তারা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পায়। এই সম্পত্তি তাদের জন্য বিনিয়োগের পথ বা নিজস্ব কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথকে সুগম করবে। 

তবে এ কথাও সত্যি যে, আমাদের মনোভাব যদি না বদলায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জীবন্নোয়ন সম্ভব হবে না। তাই তৃতীয় লিঙ্গের জন্য উত্তরাধিকার আইন যেমন বাস্তবায়িত হওয়া জরুরি, তেমনি বদলাতে হবে আমাদের মানসিকতাও।

Write A Comment