পৃথিবীর দূর্গম শহর নিয়ে তালিকা বানানো সহজ কোন কাজ নয়। দূর্গম মানে অনেক কিছুই হতে পারে। সবচেয়ে কাছের লোকালয় থেকে কতটুকু দূরত্ব, যাতায়াতের ব্যবস্থা কেমন, কী ধরণের সুযোগ সুবিধা সেখান রয়েছে এরূপ বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয়। এরপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, শহরের সংজ্ঞা আসলে কী? কত বড় জায়গায় কত মানুষ কী কী ধরণের সুযোগ সুবিধা এবং স্থাপনা থাকলে তা আসলে শহর বলে গণ্য করা চলে? ঠিক কী পরিমাণ বাসিন্দাই বা এতে থাকতে হবে? সব মিলিয়ে আসলে দূর্গম শহরের তালিকা বানানো বেশ কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। তবে এখানে আপনার জন্যই আমরা নির্বাচন করেছি পৃথিবী ৪টি দূর্গম শহর যা যে কোন বিবেচনাতেই দূর্গম বলে বিবেচিত হবে।
অ্যামাজোনিয়ান সিটি অফ ইকিউটাস, পেরু
অ্যামাজনের পেরু অংশের রাজধানী হিসেবে পরিচিত এই ইকিউটাস পেরুর ম্যায়ান্স প্রদেশ এবং লোরেটো অঞ্চলের রাজধানী। এ দুর্গম শহর যেতে চাইলে আপনাকে অ্যামাজনের বুক চিরে প্রথমেই ৪দিনের জলপথ ভ্রমণ করতে হবে। এরপর আন্দিজ পর্বতমালার বিভিন্ন বাঁকে রাস্তা পেরিয়ে তবেই পৌঁছাতে পারবেন ইকিউটাসে। যদিও এই শহরে একটি বিমানবন্দর আছে এবং পেরুর রাজধানী লিমা থেকে সরাসরি এই শহরে ফ্লাইটও আছে, তবে বিমান ভ্রমণের সামর্থ সকলের থাকে না। তাছাড়া সিঙ্ঘভাগ মালপত্র জলপথেই আনা নেওয়া করা হয়।
চাইলে পেরুর এই দুর্গম শহরকে নিয়ে বানানো চমৎকার ভিডিওটি দেখে নিতে পারেন
এই শহর থেকে কোন রাস্তাই অন্য কোন শহরের সাথে সংযুক্ত নেই। অর্থাৎ, ইকিউটাস থেকে সড়ক পথ ধরে গহীন আমাজন জঙ্গল ছাড়া আপনি আর কোথাও পৌঁছাতে পারবেন না। তবে নতুন একটি ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ তৈরির প্রক্রিয়া চলছে যা এই দুর্গম শহরকে সারামেরিজা নামক আরেকটি শহরের সাথে সংযুক্ত করবে। ২০২১ নাগাদ এই সড়ক নির্মাণ শেষ হবে। তাই নিঃসন্দেহে এটি পৃথিবীর সুর্গমতম শহরের একটি। তবে এখানকার প্রায় ৪ লক্ষ জনসংখ্যাই ইঙ্গিত করে যে, এটি দূর্গম শহর হতে পারে, বসবাসের অনুপযোগী নয়!
রাশিয়ান দূর্গম শহর পেত্রোপাভলোভিস্ক-কামস্কাটিস্কি
আয়তনের দিক থেকে রাশিয়া নিঃসন্দেহে পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ। সমগ্র ভূখণ্ডের প্রায় আটভাগের একভাগ জায়গা একাই দখল করে আছে এই দেশটি। রাশিয়ার সাথে ১৬টি দেশের সীমান্ত রয়েছে, এদেশের ভেতরেই আছে ১১টি টাইমজোন। এই দেশে তাই কয়েকটি দূর্গম শহর থাকতেই পারে। পেত্রোপাভলোভিস্ক – কামস্কাটিস্কি, শুধু শহর হিসেবেই না ব্রং আমাদের জন্য নামের উচ্চারণ হিসেবেও এ যথেষ্ট দূর্গম! এখানে নিশ্চিতভাবেই অন্য শহরের সাথে নেই কোন সড়ক পথে যোগাযোগের ব্যবস্থা। এখানে পৌঁছুতে চাইলে আপনাকে কাটতে হবে বিমানের টিকিট অথবা অপেক্ষা করতে হবে শুষ্ক মৌসুমে যখন যাত্রীবাহী ক্রুজ শিপ (জাহাজ) চলে, সে সময়ের।
পৃথিবীর দূর্গম শহরগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল এর নয়নাভিরাম, নজরকারা সৌন্দর্য্য। রাশিয়ার এই শহরটি যতই দূর্গম হোক না কেন, এর সৌন্দর্য্যের কোন শেষ নেই। তাই তো এখানেও প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটকের আনাগোনা থাকে এর সৌন্দর্য্য অবগাহন, প্যারাগ্লাইডিং এবং হরিণ শিকারের জন্য!
এ শহরটি আগ্নেয়গিরির পাদদেশে অবস্থিত। চারিদিকে সুউচ্চ পর্বতমালা থাকায় শহরের কোন স্থান থেকেই দিগন্তের দেখা পাওয়া যায় না। প্রায় সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যেই এখানে আমদানী নির্ভর। তারপরেও এ শহরে লক্ষাধিক মানুষের বাস যারা মূলত মৎস শিল্প এবং বন হতে পাওয়া কাঠ সংগ্রহের সাথে জড়িত।
ফ্ল্যাশি সিটি অফ পার্থ, অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরের কথা অনেকেই জানেন। এটি অনেক উন্নত একটি শহরও বটে। তাহলে এটি আমাদের দূর্গম শহর নিয়ে বানানো লিস্টে কী করছে? যদিও এশহরে উন্নত সুযোগসুবিধার কমতি নেই। নেই যোগাযোগ ব্যবস্থা কিংবা আধুনিক জীবন যাপনের অন্যান্য সুবিধাও কোন কমতি। এই শহরে বাস করে বিশ লক্ষাধিক মানুষ। কিন্তু আপনি কী জানেন, এর সবচেয়ে কাছের উন্নত শহর, যেখানে কমপক্ষে এক লাখ মানুষ বা করে, সেই অ্যাডিলেড থেকে পার্থের দূরত্ব কত? ২১০০ কিলোমিটার! হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, পার্থের সবচেয়ে কাছের শহরটির দূরত্ব প্রায় ১৩০০ মাইল!
তাই দূর্গম না, স্বল্পোন্নত না কিংবা আবাসের অযোগ্য না হয়েও পার্থ শুধু মাত্র দূরত্বের হিসেবে হতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে দূর্গম শহরের একটি! কেউ কেউ তো বলেন, পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার এই শহরে যাবার চাইতে সম্পূর্ণ অন্য মহাদেশে থাকা ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপপূঞ্জে যাওয়াও কম খরচের এবং কম কষ্টের! আসলে অস্ট্রেলিয়ার মাঝখানে থাকা বিশাল মরুভূমিই পার্থকে ফেলে দিয়েছে অন্য সব উন্নত শহর থেকে দূর এক প্রান্তে।
অটোনোমাস সিটি অফ মেডোগ, তিব্বত
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, ভূমিধ্বস আর প্রবল তুষারপাত, সব মিলিয়ে আমাদের তালিকায় থাকা সবচেয়ে দূর্গম শহর বুঝি তিব্বতের এই সিটি অফ মেডোগ। মাত্র ১০ হাজার লোকের বাস এই শহরে। এই ২০১৩ সাল এই শহরে যবার জন্য রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এর আগে এই শহরের মানুষকে পায়ে হেটে কিংবা ঘোড়ায় চড়ে পারি দিতে হত পর্বতে ঘেরা বন্ধুর পথ, যে পথের এলিভেশন প্রায় ৪০০০ মিটার বা চার কিলোমিটার! আর এ পথের মাঝে কোন বিপদ হলে তো কথাই নেই, হাসপাতাল তো অনেক পরে, কয়েক দিন পথের মাঝে নেই কোন সামান্য চিকিৎসাকেন্দ্রও!
তাই এ শহরের বাসিন্দাদের চিকিৎসা কিংবা শিক্ষা শুবিধা যৎসামান্য। আবহাওয়া ভেদে বছরে ৩-৪ মাস এই শহর সাথে বহির্বিশ্বের সাথে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এ যেন সংজ্ঞানুসারেই দুর্গম শহর !
আমাদের এই তালিকায় বেশ অনেকগুলো দূর্গম শহরের কথাই উল্লেখ করা হল। শহর যেমনই হোক, চাইলে বিভিন্নভাবে তা উপভোগ করা যায়। এসব শহরের অনেকগুলোতে তো অনেক পর্যটকও যান। এ সব শহর সম্পর্কে আপনার মতামত কী? আপনি কোন লিস্ট বানালে আর কোন কোন শহর থাকবে সেখানে, জানিয়ে দিন আমাদেরকে কমেন্টে।