Reading Time: 4 minutes

ভারতীয় উপমহাদেশ ৭০টিরও বেশি শাসক গোষ্ঠীর অধীনে ছিল। কিন্তু কেউ উপমহাদেশের ইতিহাসকে ব্রিটিশ রাজের মতো গভীরভাবে প্রভাবিত করে নি। ব্রিটিশরা ২০০ বছর ধরে আমাদের পুরো অঞ্চল শাসন করেছিল। এর ফলে এদেশের মানুষ অনেক অযাচিত অত্যাচারের শিকার হলেও ব্রিটিশরা আমাদের শিল্প এবং স্থাপত্যে অনেক উন্নতি করে। সেই সময়ের বেশিরভাগ স্থাপনাই ভিক্টোরিয়ান যুগের স্থাপত্য শিল্পের প্রভাব বহন করে। ব্রিটিশ আমলে প্রতিটি কাঠামো নির্মাণে যেই স্থাপত্যশৈলী ব্যবহৃত হতো তা ভিক্টোরিয়ান স্টাইল হিসাবে পরিচিত। বাংলাদেশে ভিক্টোরিয়ান আর্কিটেকচার স্টাইলের কিছু স্থাপনা আছে, যেগুলো এখনো স্বমহিমায় উজ্জ্বল। সেসব নিয়েই আমাদের আজকের ব্লগ। 

ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের স্থাপত্যশৈলী 

ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের স্থাপত্যশৈলী বলতে আসলে একটি নির্দিষ্ট স্থাপত্যশৈলী বদলে অনেকগুলো একাধিক স্থাপত্যশৈলীকে বাঁচিয়ে তোলাকে বোঝায়। রানী ভিক্টোরিয়ার (১৮৩৭-১৯০১) আমলকে ভিক্টোরিয়ান যুগ বলা বলা হতো। এবং সে সময়ের স্থাপত্যকেই মূলত ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের স্থাপত্য বলা হয়। 

যদিও ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের স্থাপত্যশৈলী আসলে অনেকগুলো স্টাইল, ইন্টারপ্রিটেশন এবং অনান্য ঐতিহাসিক স্টাইলের ইলেক্ট্রিক পুনুরুজ্জীবনের মিশ্রণ। ঐতিহাসিকভাবে, ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের স্থাপত্যশৈলীর মাঝে পুরনো গোথিক স্থাপত্যশৈলীর নতুন রূপ, ফোক ভিক্টোরিয়ান, গ্রিক স্থাপত্যশৈলীর নতুন রূপ, ইতালিয়, দ্বিতীয় এমপায়ার, রোমান স্থাপত্যশৈলীর নতুন রূপ, কলোনিয়াল স্থাপত্যশৈলীর নতুন রূপ এমনকি শেষের দিকে জনপ্রিয় রানী অ্যানের স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব দেখা গেছে।  

আহসান মঞ্জিল 

আহসান মঞ্জিল
আহসান মঞ্জিল ইংরেজ-ফরাসি যুদ্ধ সহ আরো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে

আহসান মঞ্জিল বাংলাদেশে ভিক্টোরিয়ান আর্কিটেকচারের অনন্য উদাহরণ। এক সময়ের নবাবদের আবাসিক প্রাসাদ, পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিল ইন্দো-সারাসনিক স্থাপত্যশৈলী ও গোথিক পুনর্জাগরণ কিংবা ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের স্থাপত্যশৈলীর সাথে প্রচুর সাদৃশ্যপূর্ণ। এই বিশাল প্রাসাদের নির্মাণ ১৯ শতকের শেষ দিকে শেষ হয়েছিল। দুই তলা এই প্রাসাদ দুটো ভাগে বিভক্ত। রঙমহল এবং অন্দরমহল। 

প্রাসাদের ভেতরটা বিভিন্ন ধরণের আলংকারিক ছাঁটাইযুক্ত লতাপাতা, আকর্ষণীয় কাঠের সিঁড়ি এবং একটি কৃত্তিম সিলিং দিয়ে সুন্দরভাবে অলঙ্কৃত। এই দর্শনীয় ভবনটি ইংরেজ-ফরাসি যুদ্ধ সহ আরো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৮৫ সালে ঢাকা জাতীয় জাদুঘর এর মালিকানা গ্রহণ করে এবং এরপর এটাকে জাদুঘর বানিয়ে ফেলা হয়। বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত এই বিশাল প্রাসাদ দেখতে হলে সবাইকে পুরান ঢাকার কুর্মিটোলায় যেতে হবে।  

কার্জন হল  

কার্জন হল
কার্জন হল ভিক্টোরিয়ান এবং মুঘল স্থাপত্যের একটা মিশ্রণ

কার্জন হল বাংলাদেশে ভিক্টোরিয়ান আর্কিটেকচারের স্থাপত্যগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপত্য বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে নির্মাণ করা হয়। ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের নামে এটির নামকরণ করা হয়েছিল। ১৯০৪ সালে লর্ড কার্জনই এই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। প্রথমে এটাকে টাউনহল বানানোর চিন্তা করা হলেও ১৯২১ সালে এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান পরিষদের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। 

এটার মাঝে বিখ্যাত ইন্দো-সারাসনিক এবং গোথিক স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব দেখা যায়। এই ভবনের স্থাপত্যশৈলীর সাথে বিশ্ব বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনের সাদৃশ্য রয়েছে। এই ভবনের স্থাপত্যশৈলি পুরোপুরি ভিক্টোরিয়ান নয়। বরং ভিক্টোরিয়ান এবং মুঘল স্থাপত্যের একটা মিশ্রণ। 

পুরনো উচ্চ আদালত ভবন 

পুরনো উচ্চ আদালত ভবন 
সাদা মার্বেলের ফ্লোর এবং একটি দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি পুরনো উচ্চ আদালতের ভবনকে এদেশের ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম দারুণ উদাহরণ বানিয়েছে

পুরনো উচ্চ আদালত ভবন এবং কার্জন হল প্রায় একই সময়ে স্থাপিত হলেও দুটোর স্থাপত্যশৈলীর মাঝে প্রচুর পার্থক্য আছে। একদিকে কাজর্ন হল যেমন তার গোথিক স্থাপত্যশৈলীর গৌরব নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, অন্যদিকে পুরনো উচ্চ আদালত ভবন রেনেসাঁর স্থাপত্যশৈলীর দুর্দান্ত উদাহরণ। প্রাথমিকভাবে এই ভবনটি ইস্ট বেঙ্গল এবং আসামের গর্ভনরের জন্য বানানো হলেও পরে এটা উচ্চ আদালতের অংশ হয়ে যায়।  

ভবনে প্রবেশের মুখেই একটা বারান্দা রয়েছে, যা কয়েকটি করিয়ান্থান কলামের দ্বারা একটা ত্রিভুজাকার ফ্রন্টনের নিচে অবস্থিত। ভবনটির উপরে একটি আকর্ষণীয় গম্বুজ আছে, যেই গম্বুজ একটি কলামসজ্জিত রিংয়ের উপরে অবস্থিত। সাদা মার্বেলের ফ্লোর এবং একটি দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি পুরনো উচ্চ আদালতের ভবনকে এদেশের ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম দারুণ উদাহরণ বানিয়েছে। 

রূপলাল হাউজ 

রূপলাল হাউজ
রূপলাল হাউজের বর্তমান অবস্থা তেমন ভালো না হলেও এটা ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম দারুণ উদাহরণ

স্টিফেন আরটুন নামে এক আমেরিকান ব্যবসায়ী দ্বারা ১৮২৫ সালে নির্মিত রূপলাল হাউজ ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের স্থাপত্যশৈলীর এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এটি পূর্বে আরটুন হাউজ নামে পরিচিত ছিল। ১৮৪০ সালে জমিদার রূপলাল দাস এবং রঘুনাথ দাস আরটুন সাহেবের থেকে এই বাড়িটি কিনে নেন। কিন্তু রূপলাল দাস ১৮৬৬ সালে ভাইসরয় লর্ড ডাফেরিনের নামে একটা বল ডান্স পার্টি থ্রো করার পর এই ভবন পাদপ্রদিপের আলোয় আসে। 

এই বাড়িটি তিনটি আলাদা ব্লকে বিভক্ত। রূপলাল ব্লক, রঘুনাথ ব্লক এবং সেন্ট্রাল ব্লকের তিনটি আলাদা স্থাপত্যশৈলী আছে। এই ব্লকগুলো গ্রাউন্ড ফ্লোরে একে অন্যের থেকে আলাদা হলেও উপর তলায় বিভিন্ন পথের মধ্যে দিয়ে সংযুক্ত। রূপলাল ব্লকটি নিও-ক্লাসিকাল স্থাপত্যশৈলী ব্যবহার করে বানানো হয়েছে এবং এর করিয়ান্থান কলামগুলোর উপরে একটা ত্রিভুজ আকৃতির পেডিমেন্ট রয়েছে। রঘুনাথ ব্লকে ভারতীয় বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলী ব্যবহার করা হয়েছে। উত্তরদিকের ঢোকার পথে কোনো খিলান নেই। সেন্ট্রাল ব্লকটা রূপলাল ব্লকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন, কিন্তু আহসান মঞ্জিলের মতো করে বানানো হয়েছে। রূপলাল হাউজের বর্তমান অবস্থা তেমন ভালো না হলেও এটা ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম দারুণ উদাহরণ। 

ব্রিটিশ শাসন শুরুর অনেক আগে থেকেই উপমহাদেশের শিল্প এবং স্থাপত্যশৈলী সমৃদ্ধ ছিল। ভারত এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশ জুড়ে দর্শনীয় স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ এই সত্যের প্রমাণ দেয়। তবে ব্রিটিশ আমলে আমাদের স্থাপত্যশৈলী আরো অসাধারণ হয়েছে, এবং বাংলাদেশে ভিক্টোরিয়ান আর্কিটেকচারের এ উদাহরণগুলো সেটির প্রমাণ। 

Write A Comment