Reading Time: 5 minutes

স্বাছন্দ্যে এবং নিরাপদে ভ্রমণের জন্য রেলপথ হল আদর্শ। সারা পৃথিবীতেই অন্য যে কোন মাধ্যমের চেয়ে রেলপথে ভ্রমণ যেমন আরাম তেমনি নিরাপদ। একটি দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা কতটা উন্নত তা অনেক সময়ই নির্ধারিত হয় সেদেশের রেল যোগাযোগ কতটা উন্নত তার উপরে। বাংলাদেশে রেলপথের কার্যক্রম অনেক অনেক পুরোনো, সেই বৃটিশ আমলের। তাঁরা সেসময়েই সমগ্র উপমহাদেশে জালের মত ছড়িয়ে দিয়েছিল রেলের নেটওয়ার্ক। দেশভাগ হবার পর বাংলাদেশের ভাগে যেটুকু রেললাইন পরে তাঁর উপর ভিত্তি করেই আজকের বাংলাদেশ রেলওয়ে দাড়িয়ে আছে।

দীর্ঘতম রুট সম্পর্কে

ট্রেনে মানুষ

অনেকেরই জানতে ইচ্ছে হতে পারে, দেশে সবচেয়ে লম্বা রুটে চলাচল করে এমন ট্রেন কোনটি? দেশে একমাত্র বরিশাল বিভাগ ছাড়া বাকি সব বিভাগেই আছে রেল যোগাযোগ, তাই ঢাকা, সিলেট, খুলনা, চটগ্রাম কিংবা পঞ্চগড়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূরে ভ্রমণ করে কোন ট্রেনটি? অনেকেই জেনে অবাক হবেন যে শুধু প্রথম নয় বরং দুরত্বের দিক থেকে প্রথম ৪-৫টি ট্রেনের একটিও যাত্রীবাহী বা প্যাসেঞ্জার প্যাসেঞ্জার ট্রেন না। সবচেয়ে বেশি দূরত্বে চলা ট্রেনের প্রথম দিকের সবগুলোই হল মালবাহী বা ফ্রেট ট্রেন! স্বাভাবিকভাবেই যে ট্রেনটি (কুড়িগ্রাম বিসি) চট্টগ্রামের সেই সিজিপিওয়াই থেকে শুরু করে দেশের অপর প্রান্তে একদম কুড়িগ্রাম পর্যন্ত ভ্রমণ করবে তাকে বাংলাদেশে রেলপথের বিশাল এক অংশ পারি দিতে হবে। 

তবে, মালবাহী ট্রেনকে পাশে রেখে শুধুমাত্র যাত্রীবাহী ট্রেন নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। চলুন দেখে নেয়া যাক বাংলাদেশে রেলপথের সবচেয়ে বেশি দূরপথ পারি দেয় কোন প্যাসেঞ্জার ট্রেনগুলো?

১) একতা / দ্রুতজান / পঞ্চগড় এক্সপ্রেস –  ৫০০+ কিলোমিটার

পঞ্চগড় এক্সপ্রেস
উদ্বোধনের সময়ে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস

বাংলাদেশে রেলপথের ইতিহাস শতবছরের পুরানো, অথচ দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ পথের ট্রেনটি সবচেয়ে নতুন ট্রেনগুলোর একটি! বলছি পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনটির কথা। এইতো সেদিন ২০১৯ সালে ২৫শে মে এই নতুন ট্রেনটি চালু করা হয় পঞ্চগড়বাসীর বহুদিনের চাহিদার কথা মাথায় রেখে। এটি রাজধানী ঢাকা এবং দেশের সর্বউত্তরের জেলাগুলোর একটি পঞ্চগড়ের মধ্য দিয়ে চলাচল করে। এবং এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম রুটের প্যাসেঞ্জার ট্রেন, অতিক্রান্ত দূরত্ব প্রায় ৫১০ কিলোমিটার। 

পঞ্চগড় এক্সপ্রেসে ১২টি বগি রয়েছে। এতে শোভন চেয়ার, এসি চেয়ার, এসি সিট এবং এসি বার্থে যাত্রীরা ভ্রমণ করতে পারেন।

একই রুটে একতা / দ্রুতজান এক্সপ্রেস নামে আরেকটি এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করে। এই ট্রেনটির ইতিহাস বেশ পুরনো, ১৯৮৬ সাল থেকে ঢাকা – দিনাজপুর রুটে এই ট্রেনটি চলাচল করত। তখন বঙ্গবন্ধু সেতু না থাকায় এক্সপ্রেস ট্রেনটি দিনাজপুর থেকে ছেড়ে যমুনা সেতুর পশ্চিম পাশে পার্বতীপুর এসে বালাসী ঘাটে যাত্রী নামিয়ে দিত। সেখান থেকে যাত্রীগণ রেলওয়ের নিজস্ব ফেরী সেবার মাধ্যমে যমুনা নদী পাড় হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটে পৌঁছাতেন। সেখানে একতা এক্সপ্রেসের অন্য রেকটি পুনরায় যাত্রা শুরু করত ঢাকার উদ্দেশ্যে । যমুনা সেতু চালু হলে এটির ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে ট্রেনটি পঞ্চগড় পর্যন্ত বর্ধিত হয়। 


পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের বিষদ রুটঃ কমলাপুর – বিমান বন্দর – শান্তাহার – পার্বতীপুর – দিনাজপুর – পীরগঞ্জ – ঠাকুরগাঁ রোড – বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেশন (পঞ্চগড় স্টেশন)
এই ট্রেনগুলোর কোন বন্ধের দিন (অফ ডে) নেই।

২) কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস = ৪৫০+ কিলোমিটার

এই ট্রেনটি বয়সে আরও নতুন, ১৬ অক্টোবর ২০১৯ সালে এই ট্রেনটি ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানিকৃত ঝা-চকচকে,  নতুন পিটি ইনকা কোচ দিয়ে ঢাকা – কুড়িগ্রামের মধ্যে যাত্রা শুরু করে। এই ট্রেনের বগি সংখ্যা ১৪টি এবং ৬০০+ মানুষ এতে ভ্রমণ করতে পারেন। পথিমধ্যে প্রায় ৪৫৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস। এটি কুড়িগ্রাম থেকে ছাড়ে সকালে এবং ঢাকায় পৌঁছে বিকাল ৫টার দিকে। আর ঢাকা থেকে রাতে ছেড়ে ভোরবেলা পৌঁছায় কুড়িগ্রামে

কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের বিষদ রুটঃ কমলাপুর – বিমান বন্দর – মাধনগর – শান্তাহার – জয়পুরহাট – পার্বতীপুর – বদরগঞ্জ – রংপুর – কাউনিয়া – কুড়িগ্রাম 

কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের সাপ্তাহিক বন্ধের দিন বুধবার। 

৩) রংপুর এক্সপ্রেস = ৪৪৭ কিলোমিটার

ট্রেন
বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন

রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি বাংলাদেশে রেলপথের অতিক্রান্ত দুরত্বের দিক থেকে তৃতীয়। এই ট্রেনটি চালু হয় ২০১১ সালে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে এটি নতুন বগি পায়। সপ্তাহে ৬দিন এই ট্রেনটি চলে, রবিবার এর অফ ডে। যাত্রাপথে ১০ ঘন্টা সময়ে এটি প্রায় ৪৪৭ কিলোমিটার পথ আতিক্রম করে। এর বগি সংখ্যা ১১টি।

রংপুর এক্সপ্রেসের বিষদ রুটঃ কমলাপুর – বিমান বন্দর – মাধনগর – শান্তাহার – জয়পুরহাট – পার্বতীপুর – বদরগঞ্জ – রংপুর 

৪) রূপসা / সীমান্ত এক্সপ্রেস = ৪৪৬ কিলোমিটার

রূপসা এক্সপ্রেস
খুলনা – চিলাহাটি রুটে চলাচলকারী রূপসা এক্সপ্রেস

বাংলাদেশ অনেকক্ষেত্রেই ঢাকা কেন্দ্রিক একটি দেশ। তাই প্রায় সব ট্রেনই ঢাকার সাথে চলাচল করে। কিন্তু আমাদের তালিকায় আছে রূপসা এক্সপ্রেস এবং সীমান্ত নামে ট্রেন দুটি যেগুলো চলাচল করে খুলনা থেকে শুরু করে দেশের সীমান্তবর্তী নীলফামারীর চিলাহাটি পর্যন্ত। এগুলো এক একটি বিলাসবহুল ব্রডগেজ ট্রেন। বাংলাদেশে যে কটি দীর্ঘ রেল রুট রয়েছে তার মধ্যে খুলনা থেকে চিলাহাটি অন্যতম। ব্রডগেজে চলাচলকারী রূপসা এক্সপ্রেস উদ্বোধন হয় ৫ই মে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে এদের বগি পরিবর্তন করা হয়। 

যাত্রাপথে রূপসা এক্সপ্রেস যতগুলো স্টেশনে স্বাভাবিকভাবেই বিরতি দেয়, তাও অনন্য! প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার এই রুটে ট্রেনটি থামে মোট ২৪টি স্টেশনে!

রূপসা এক্সপ্রেসের বিষদ রুটঃ খুলনা – নোয়াপাড়া – যশোর – মোবারকগঞ্জ – দর্শনা – কোর্ট চাঁদপুর –  চুয়াডাঙ্গা – আলমডাঙ্গা – পোড়দহ – ভেড়ামারা – পাকশী – ঈশ্বরদী – নাটোর – আহসানগঞ্জ – শান্তাহার – আক্কেলপুর – জয়পুরহাট – বিরামপুর – ফুলবাড়ি – পার্বতীপুর – সৈয়দপুর – নীলফামারী – ডোমার – চিলাহাটি

বিশেষ সংযুক্তিঃ পাহাড়িকা, উদয়ন এক্সপ্রেস = ৩৭৭.৮৮ কিলোমিটার

বাংলাদেশে রেলপথ দুটি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত, পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল। সংগত কারণেই দেশের প্রথম ৭-৮টি দীর্ঘতম রুট পড়ে যায় পশ্চিমাঞ্চলে। আমাদের লিস্টে আগের সবগুলি ট্রেনও তাই সেই অঞ্চলেরই। পূর্বাঞ্চলের যে ট্রেনটিকে বিশেষ বিবেচনায় এই তালিকায় স্থান দেয়া হল সেটি পাহাড়িকা বা উদয়ন এক্সপ্রেস। এ দুটি ট্রেনের ইতিহাসও অনেক পুরনো। পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ১৯৮৬ এবং উদয়ন ১৯৮৮ সাল থেকে চলে আসছে। সম্প্রতি, ২০২০ সালে এসে এই ট্রেনদুটি নতুন বগি পেয়েছে। 

সিলেট – চটগ্রামের মধ্য দিয়ে চলাচলকারী ট্রেনদুটি নিঃসন্দেহে দেশের সবচেয়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা রুটে চলাচল করে। যাত্রাপথে প্রায় পৌনে চারশ কিলোমিটার পথ পারি দেয় এই ট্রেনদুটি। সিলেট ও চটগ্রাম উভয় দিক থেকেই দিনে একটি এবং রাতে একটি ট্রেন রয়েছে। 

পাহাড়িকা /উদয়ন এক্সপ্রেসের বিষদ রুটঃ  চট্টগ্রাম – ফেনী – নাঙ্গলকোট – লাকসাম – কুমিল্লা -কসবা –  আখাউড়া –  হরষপুর – নোয়াপাড়া –  শায়েস্তাগঞ্জ – শ্রীমঙ্গল – ভানুগাছ – শমশেরনগর – কুলাউড়া – মাইজগাঁও – সিলেট 

বাংলাদেশে রেলপথ এবং দীর্ঘতম রুট নিয়ে এই ছিল আমাদের আলোচনা। বিপ্রপার্টি ব্লগে আমরা প্রতিদিন লাইফস্টাইল সংক্রান্ত নানান লেখা প্রকাশ করি। ঢাকা থেকে প্রতিদিন ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের শিডিউল যেমন আছে তেমন আছে কমলাপুর রেল স্টেশন নিয়ে বানানো এই চমৎকার ভিডিও ও লেখাটি।

 

সাদা কোচসহ ট্রেন
সাদা কোচসহ একটি ট্রেন

ঘোষনাঃ পঞ্চগড় এক্সপ্রেস এবং রূপসা এক্সপ্রেস ছাড়া কোন ছবিই সেই নির্দিষ্ট ট্রেনের নয়, শুধুমাত্র সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত। 

ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা –
পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ও রূপসা এক্সপ্রেসঃ জার্জিস বিন মাহবুব
কভার ফটো এবং অন্য সবগুলোঃ জুবায়ের আহমেদ রাফছান

Write A Comment