Reading Time: 3 minutes

প্রস্তাবনা

বাংলা সনের প্রথম বছরটা কত লেখা হয়েছিল? ১? ২? ৫? ১০? জ্বি না, একটাও না। বাংলা সন যখন শুরু হয় তখন লেখাটা খুব সম্ভব ছিল, ৯৯১! হ্যা, ঠিকই পড়েছেন, ৯৯১! কিন্তু কেন? সে প্রশ্নের উত্তরই আমরা খুঁজব আজকে। খুঁজতে খুঁজতেই দেখে নেব সেই মোগল আমলে বাংলা সম্পর্কে কিছুটা, পথে দেখা হয়ে যাবে মোগল সম্রাট আকবর, তার সভায় থাকা পারস্য থেকে আগত ফতেউল্লাহ সিরাজির সাথে! চলুন, শুরু করা যাক?

আকবরের সময়ে মুগল সাম্রাজ্য এবং বাংলা

জালাল-উদ-দীন মোহাম্মদ আকবর। বাবর, হুমায়ূনের পর তৃতীয় মোগল সম্রাট। তার সময়েই মোগল সাম্রাজ্য প্রথমবারের মত বিস্তার লাভ করে সমগ্র ভারতবর্ষে। মাঝে মাঝে যখন অবিভক্ত ভারতবর্ষের মানচিত্র কল্পনা করা হয়, কেমন পিলে চমকে উঠতে হয়! একদিকে আকাশছোঁয়া হিমালয়ের দাম্ভিক অবস্থান, দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের সুগভীর জলরাশি, পশ্চিমে ভয়ানক সুন্দর সব পর্বতমালা আর পুবে, আমাদের এই জংলা, বাংলা!

জংলা শব্দটা তুচ্ছার্থে নয় বরং আক্ষরিক অর্থেই ব্যবহৃত এখানে। এই জংলার মানুষকে খুব সহজে বশে আনা যায় না। বাবর এতদূরের কথা জানতেন কিনা নিশ্চিত নয়, হুমায়ূনকে ঘোল খাইয়ে নাস্তানাবুদ করে প্রায় পথে বসিয়েছিলেন যে শের শাহ, সেটাও যখন হুমায়ূন এই বাংলার দখল নেবার চিন্তাভাবনা করছেন সেইসময়ই। 

এই বাংলা মোগলদের হাতে আসে হুমায়ূন পুত্র আকবরের আমলে। আকবর ছিলেন একজন দিগ্বিজয়ী সম্রাটের যেমন হবার কথা ঠিক তেমন। নিষ্ঠুর, নির্দয়, কৌশলী আবার একই সাথে দয়ালু, মহানুভব, ক্ষুরধার বুদ্ধিমান এবং ক্ষেত্র বিশেষে ভাগ্যবান। কারণ আকবরের বাংলা জয়ে ভাগ্যের ছোঁয়া অস্বীকার করার উপায় নেই।

কেন দরকার পড়ল বাংলা সন?

বাংলা সন

সম্রাট আকবরের আমলে বাংলাকে তো বশে আনা গেল, কিন্তু বশে রাখতে তো হবে? শস্য প্রসবা উর্বর এ মাটি থেকে খাজনার পরিমাণ নেহায়েত কম না। শতাব্দী, সহস্রাব্দে আর যাই বদলাক না কেন, এই খাজনা, কর, ট্যাক্সের ধারনা বদলায়নি। বাংলাকে নিয়ে সমস্যা বাধল এই খাজনা আদায়ের সময়কে নিয়েই! 

মোগল আমলের শুরু থেকেই চলে আসছিল আরবী তথা হিজরি ক্যালেন্ডার। হিজরি মাস দেখেই গণনা করা হত দিনক্ষণ, আজকের দিনের সাথে তুলনা করলে, কবে সংসদে হবে “বাজেট অধিবেশন!” মোগল সাম্রাজ্যে সবকিছু যখন ঠিকই চলছিল তখন দৃশ্যপটে আগমন বাংলার।

বাংলার জন্য হিজরি সন গণনার একটা সমস্যা আছে, এটি চন্দ্রতিথিতে চলে। চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় প্রতিবছর এই মাসগুলো ১০-১১ দিন করে এগিয়ে আসে। কিন্তু কৃষকের ফসল তো আসে মৌসুম দেখে, যার নির্ভরশীলতা সূর্য্যের উপর। তাই খাজনা আদায়ের সময়ে দেখা যেত কৃষকের ফসল কাটার সময়ই আসে নি। অথবা তা পার হয়ে গিয়েছে ২-৩ মাস আগেই! আর হাতে ফসল না থাকলে যতই শূলে চড়ানো হোক, কৃষকের কাছে দেবার মত কিছুই নেই। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে দু-তিন মাস কি ফসল/খাজনা জমিয়ে রাখা যেত না? উত্তর, না। আমাদের কৃষকেরা এখন যেমন হাড় জিড়জিড়ে, দিন আনেন দিন খান, তখনও তাই ছিলেন। তাঁরাই আমাদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখেন অথচ খাবার নিয়ে হয়ত সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় তাদেরকেই! কয়েকশ বছরেও এই অবস্থা বদলায়নি। তাঁরা সবসময়ই দিন আনি দিন খাই ছিলেন, ‘সেভিংস’ এর আইডিয়া তাঁদের কখনোই ছিল না।

আকবর দ্যি গ্রেটের “গ্রেট আইডিয়া”

অন্য কোন শাসক হলে হয়ত বলতেন, এত বুঝি সুঝি না বাপু, তুমি ভাই! হয় আমার খাজনা দাও নাইলে জরিমানা! রাজা-রাজরাদের কাহিনী পড়লে এটাই স্বাভাবিক মনে হয়। তবে আকবরকে ডাকা হত আকবার দ্যি গ্রেট। দক্ষ প্রশাসক আকবর সেই স্বাভাবিক পথে হাটলেন না। তিনি বুঝতেন প্রকৃতির সাথে জোর করে লাভ নাই, প্রকৃতি বশ মানবে না। আমাদেরকেই তার বশ মানতে হবে, প্রণয়ন করতে হবে বাংলা সন ।

আকবরের নির্দেশ অনুযায়ী তার সভাসদ এবং জ্যোতিষ, আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজি বছর গণনার এক নতুন, চমকপ্রদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন। বাংলায় মৌসুমের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বছরের চল হয়তা আগে থেকেই ছিল, আমীর সাহেব সেই জিনিসকে আরো স্ট্যান্ডার্ডাইজ করলেন। 

কিন্তু ৯৯১ থেকেই কেন শুরু?

আমীর সাহেবের হিসেব মতে, আকবর যখন সিংহাসনে বসেন তখন হিজরি ৯৬৩ সাল, ইংরেজির হিসাবে ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর যেদিনই দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে তিনি হিমুকে পরাজিত করেছিলেন। এর সাথে মিল রেখে সেই সালটিকে ধরা হল বাংলা ৯৬৩ সন। অর্থাৎ বঙ্গাব্দ শুরুর বেজলাইনই হল ৯৬৩। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যে আকবর বাংলা জয় করেছেন আরও পড়ে। বাংলায় খাজনা আদায়ে যে এরূপ সমস্যা হতে পারে তা বুঝতেও কিছু সময় লেগেছে। এবং এই বাংলা সন যখন হিসেব শুরু হয় তখন সিংহাসনে আকবরের ২৮বছর শেষ হয়ে ২৯তম বছর চলছে। তাই খুব সম্ভব বাংলা প্রথম সনটা হল ৯৬৩+২৮ = ৯৯১ বঙ্গাব্দ! 

ফসলী সন

ইংরেজি ১৫৮৪ সালে দাপ্তরিকভাবে চালু হওয়া এই ক্যালেন্ডার এর নাম দেয়া হয় “তারিখ-ই-ইলাহী”। ইলাহী সনের শুরু ধরা হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে। আর তা ছিল হিজরি ৯৬৩ সন। এই ক্যালেন্ডার প্রচলন হলে কৃষকেরা খাজনা পরিশোধে আর সমস্যায় পড়েন না। সৌরবছর হিসেব করার ফলে বছরের শুরুর দিন আর বদলে যায় না, ফসল কাটা হবার পরেই তাদের কর পরিশোধের সময় আসে। ফলে কৃষকদের কাছে “তারিখ-ই-ইলাহী” পরিচিতি পায় “ফসলী সন” হিসেবেই। সেই ফসলী সন থেকেই আজকের বঙ্গাব্দ। আকবরের পরে “তারিখ-ই-ইলাহী” আর টিকে না থাকলেও টিকে আছে বঙ্গাব্দ।

পরিশিষ্ট 

বাংলা সন গণনা কিংবা এই বঙ্গাব্দের হিসাব যে আকবরের সময় থেকেই এসেছে তা নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে কিছুটা দ্বিধাবিভক্তি দেখা যায়। বঙ্গাব্দের জন্মকথা উঠলে মোট চারজন শাসকের কথা উঠে এক্ষেত্রে। তিব্বতিয় রাজা স্রং সন, গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক, সুলতান হোসেন শাহ এবং মোগল সম্রাট আকবর। তবে বেশিরভাগ পন্ডিত মত দেন সম্রাট আকবরের পক্ষেই। আর সম্রাট আকবরই প্রথম বাংলা সাল প্রবর্তন করেছেন কী না তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও তিনি যে হিজরি সালের সাথেের সামাঞ্জস্য রাখতে এর বিশেষ সংস্কার করেছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই আমাদের আলোচনা আকবরকে ঘিরেই! 

Write A Comment