Reading Time: 4 minutes

আজ মহান মে দিবস। কোটি শ্রমজীবি মানুষের দাবি ও অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে সুপরিচিত এই দিনটি। কিন্তু কিভাবে এই এই মে দিবস? কেনই বা একে পালন করা হয় শ্রমজীবি মানুষের মুক্তির দিন হিসেবে? চলুন জেনে নেয়া যাক।

যেভাবে শুরু

মানবসভ্যতার ইতিহাসের এক বড় অংশ জুড়ে আছে দুর্বলের উপর সবলের শোষণ আর অত্যাচারের কাহিনী। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নরূপে শোষকশ্রেনী তাঁদের স্বার্থ হাসিলের জন্য নির্দয় আচরণ করেছে। আমরা যে সময়ের কথা বলছি সেটি ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। সেসময় দিনে কাজ করতেন গড়ে ১২ ঘণ্টা, অথচ মুজুরি পেতেন নামেমাত্র। লাভের গুড় সবটাই যেত মালিকে পেটে। উল্টোদিকে শ্রমিকদের জীবনযাপন ছিল মানবেতর। শ্রমিকদের উপর অনায্য অপব্যবহারের সাথে সাথে ছিল মালিকপক্ষের অনবরত অকথ্য নির্যাতন

আট ঘন্টা কাজের দাবী সম্বলিত পোস্টার
আট ঘন্টা কাজের দাবী সম্বলিত পোস্টার

১৮৬০ সালে শ্রমিকরা মানুষ হিসেবে তাঁদের দাবি আদায়ে সোচ্চার হন। তাঁদের দাবি ছিল মজুরি না কমিয়ে সারা দিনে কাজ আট ঘণ্টায় নামিয়ে আনা। এজন্য আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার নামে একটি সংগঠনও তৈরি হয় পরবর্তীকালে। এই সংগঠন শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অবিরত আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের স্লোগান ছিল-

“দিনে চাই আট ঘন্টা কাজ, আট ঘন্টা বিশ্রাম, আর বাকি সময় নিজের ইচ্ছায় চলার অধিকার”
(Eight hours for work, eight hours for rest, eight hours for what we will)

একটি ট্রাজেডির পূর্ব ঘটনাবলী

পৃথিবীর কোন দাবিই একদিনে আদায় হয় না, তাই এভাবে কেটে গেল ২৪টি বছর। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক একই দাবীতে আন্দোলন শুরু করেন। তারা এ দাবী কার্যকর করার জন্য ১৮৮৬ সালের পহেলা মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলনকে নতুন এক পর্যায়ে নিয়ে যান। পরবর্তীতে বারবার মালিকপক্ষের কাছে দাবি জানানো হলেও মালিকপক্ষ তাতে টূ শব্দ করেন না, দাবী মেনে নেয়া তো দূরে থাক। শ্রমিকদের মনে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে, বিদ্রোহ ওঠে চরমে। আর শিকাগো শহর হয়ে ওঠে প্রতিবাদ-বিদ্রোহের মূল মঞ্চ।
পহেলা মে যতই এগিয়ে আসছিল, দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ যেন হয়ে উঠছিল অবধারিত। মালিক শ্রেণি ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছিল । পুলিশ বরাবরের মতই সবলের পক্ষ নিয়ে শ্রমিকদের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিল। সেবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন লাখ শ্রমিক পহেলা মে কাজ ফেলে নেমে আসেন রাস্তায়। আন্দোলন চরমে ওঠে।

হে-মার্কেট ট্রাজেডি

৪ মে, ১৮৮৬ , সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। শত বাঁধা বিপত্তির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট স্কয়ার নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। এর আগে ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রা হয়েছিল। এরই সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকেরা এটি করেছিলেন।
এ আন্দোলনের এক পর্যায়ে অগাস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ পাশে দাঁড়ানো পুলিশ দলের নিকট একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। ফলশ্রুতিতে একজন পুলিশের তৎক্ষণাৎ এবং পরবর্তীতে আরও ছয়জনের মৃত্যু হয়। এর পরপর পুলিশ শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে। দুইপক্ষেই অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি থাকাই দ্রুতই এটি রায়ট বা দাঙ্গায় পরিণত হয়। এতে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন।

মিথ্যা অভিযোগ গঠন এবং সর্বোচ্চ শাস্তি 

এই রায়টের শাস্তিস্বরূপ পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয় এবং অগাস্ট স্পীজ-সহ মোট আটজনকে প্রহসনমূলকভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাদের মধ্যে ‘অস্কার নীবে’-কে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। ফাঁসি দেয়ার আগেই কারারুদ্ধ অবস্থায় ‘লুইস লিং’ নামের একজন আত্মহত্যা করেন। বাকি ছয়জনকে ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর তারিখে উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসি দেয়া হয়।ফাঁসিতে ঝুলার আগ মুহূর্তে অগাস্ট স্পীজ বলেছিলেন, 

“আজ তোমরা যে কণ্ঠগুলোকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিচ্ছো, এমন একদিন আসবে যেদিন আমাদের নিরবতাই এর চাইতে শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াবে!” (The day will come when our silence will be more powerful than the voices you are throttling today.)

সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হল, এ বিচার এবং শাস্তি, উভয়ই যে  মিথ্যা ছিল তা শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। ২৬ জুন ১৮৯৩ ইলিনয়ের গভর্নর জন পিটার অল্টগেল্ড-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, মিথ্যে আর অপরাধমূলক ছিল ওই বিচার। পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।
শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে পহেলা মে পালিত হয় শ্রমিকদের আত্মদান আর দাবি আদায়ের দিন হিসেবে।

স্মৃতিস্তম্ভে অগ্রগামীদের স্মরণ

স্মৃতিফলক

ফাঁসিপ্রাপ্ত পাঁচজন শহীদ শ্রমিক সমাহিত হন শিকাগোর ফরেস্ট পার্কে জার্মান ওয়াল্ডহেইম কবরস্থানে (বর্তমানে যা ‘ফরেস্ট হোম কবরস্থান’)। ১৮৯৩তে মিথ্যা বিচার প্রমাণিত হলে তাঁদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয় ভাস্কর আলবার্ট ওয়েইনার্টের নকশায়। এর ঠিক একশ’ বছর পর এসে সেই স্মৃতিস্তম্ভটিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ন্যাশনাল হিস্টোরিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে ঘোষণা করে। গ্রানাইটের তৈরি ১৬ ফুট উঁচু এই স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে লেখা রয়েছে অগাস্ট স্পীজের সেই সর্বশেষ উক্তিটি-

“THE DAY WILL COME WHEN OUR SILENCE WILL BE MORE POWERFUL THAN THE VOICES YOU ARE THROTTLING TODAY”

স্তম্ভটির পিছনের দৃশ্যে রয়েছে গভর্নর অল্টগেল্ডের একটি ব্রোঞ্জের ফলক যা তার ন্যায়বিচারের প্রতীক।

বিশ্বব্যাপী মে দিবস পালন

১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলন। এ সম্মেলনে  পয়লা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় সম্ররবসম্মতিক্রমে। পরবর্তী বছর থেকে ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসাবে। বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের প্রায় আশি-টিরও বেশি দেশে মে দিবস সরকারি ছুটির দিন। এছাড়া বেশ কিছু দেশে বেসরকারিভাবে পালিত হয়।

মজার ব্যাপার হলো যে দেশে এর জন্ম সেই যুক্তরাষ্ট্রেই মে দিবস পালিত হয় না। একই কথা কানাডার ক্ষেত্রেও। অজানা কারণে মে দিবসের বদলে এই দুটি দেশ সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার শ্রমিক দিবস পালন করে থাকে।

মে দিবসের অন্য একটি  উদযাপন

মে দিবস যে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের উদযাপন তা প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু এই দিনের আরেকটি কম পরিচিত উদযাপনও কিন্তু রয়েছে। উত্তর গোলার্ধে এটিকে মৌসুম পরিবর্তনের একটি উৎসব হিসেবে উদযাপন করা হয় পহেলা মে-কে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ উষ্ণ আবহাওয়ার শুরুর সময় হিসেবে মে দিবসে কর্মসূচি গ্রহণ করে। এটি বিশ্বব্যাপী তুলনামূলক কম প্রচলিত হলেও ের ইতিহাস অনেক পুরনো। 

Write A Comment