Reading Time: 4 minutes

খাতা-কলমে ভৌগোলিক অবস্থানের জোরে নিজেদের আমরা ‘নাতিশীতোষ্ণ’ অঞ্চলের বাসিন্দা দাবি করি। অথচ ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ এখন বড্ড বেশি ট্রেন্ডি, আদতে আমরা গ্রীষ্মপ্রধান এক দেশে বাস করছি। তাই অক্টোবরের মাঝামাঝি যখন ভীষণ আদুরে আর নিভৃত শীতের ঘ্রাণ কড়া নাড়ে নাগরিক খোলা জানালায়, আমরা বেশ আদিখ্যেতা করেই বরণ করে নেই তাকে। আর ডিসেম্বর-জানুয়ারির শীত তো আরো জম্পেশ! জুন-জুলাইয়ের গনগনে কড়াইয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে, আমরা তো এই শীতের কথা মনে করেই কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর ভাষায় বলে উঠি, “শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা?’’ ইট-পাথরের মেট্রোপলিটনে কেমন হয় আসলে শীত? কতটা বদলের ছোঁয়া লাগে আমাদের জীবনে বা প্রাণের গভীরে? সেসবের উত্তর খুঁজতেই লিখছি ‘শীতের কথকতা’। 

হিমের চাদর

হিমের চাদর
সকালবেলায় নিশ্ছিদ্র থাকে এই চাদরের আবরণ

সাহেবি কেতায় দরজায় কড়া নেড়ে ঘরে ঢোকে শীত। প্রথমে পাঠায় কুয়াশার চিঠি, তারপর শিশিরে ভেজা ঘাসের ঘ্রাণ। কী নাম দেবো এই ঘ্রাণকে? সতেজতার ঘ্রাণ? নাকি আরবান ডিকশনারি নতুন কোনো নামে ডাকছে একে? জানা নেই আমার! তবে ঘ্রাণটা বড় চেনা। মনে করিয়ে দেয় স্কুলের মাঠের কথা, যেখানে বহু আগে ফেলে এসেছি সারি বেঁধে ‘জাতীয় সংগীত’ গাওয়ার সকাল।

খানিকটা সময় পেরোলে লাজুক, ধূসর হিমের চাদরে ঢেকে যায় নেক্রোপলিস। অন্তত সকালবেলায় নিশ্ছিদ্র থাকে এই চাদরের আবরণ। অফিস যাত্রার এক ফাঁকে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে দেখুন, কী ভীষণ স্নিগ্ধ আর স্পষ্ট কুয়াশার ঘ্রাণ বাতাসে! মনে হয় বহুদিন পর দেখা হলো প্রাণের বন্ধুর সাথে। এ কথাও সত্যি যে, বেলা যত বাড়ে, জীবন ও জীবিকার তাড়নায় কেউ আর তেমন খেয়াল করেনা এই হিমের আহ্বান। উপায়ও নেই তেমন। যেসব বহুতল ভবনে আমাদের কর্মস্থল, শিক্ষাস্থল বা আবাসস্থল, সেখান থেকে কুয়াশা ঢাকা দিগন্ত বা শিশিরে ভেজা ঘাস যোজন যোজন দূরে। 

তবে বিজ্ঞাপনী তৎপরতার কথা অস্বীকার করার উপায় নেই একদম। টিভি-রেডিও কিংবা হালের সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে যায় পেট্রোলিয়াম জেলি, বডি লোশন আর ময়েশ্চারাইজার ক্রিমের বিজ্ঞাপন। শীত জায়গা করে নেয় ফেসবুকের অলি-গলিতেও। কেউ সুকুমারের শরণাপন্ন হয়ে লেখে, ‘‘বায়ু শনশন/শীতে কনকন’, কেউ আবার জর্জ আর.আর.মার্টিন থেকে ধার করে লিখে ফেলে, ‘উইন্টার ইজ কামিং’। 

সাধারণ সাধ ও শৌখিনতা

শীতের যত প্রশংসাই করি, শীত তবু কেন যেন বড় বৈষম্যপন্থী! ডেনিম জ্যাকেট বা কাশ্মিরী শালের ফ্যাশন স্টেটমেন্ট যখন আঁকড়ে ধরে আমাদের, এই শহরেই কিছু মানুষ তখন শীত নিবারণের ‘অন্তত একটি উপায়’ এর সন্ধানে দিশেহারা! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো তাই আমাকেও প্রশ্ন করতে হয় ‘সাধারণ সাধ না শৌখিনতা?’ এর উত্তর কোনোদিন দেয়না মহাকাল বা পৃথিবী। তাই মধ্যম পন্থা অবলম্বনই শ্রেষ্ঠ উপায় মনে হয়। 

ন্যাপথলিনের ঘ্রাণে ‘আত্মগোপনে থাকা’ প্রিয় লাল কার্ডিগানটি যখন নিজের জন্য বের করে নিচ্ছেন আপনি, তখন একটু সময় করে বের করে নিতে পারেন পুরোনো সোয়েটার ও কম্বলগুলোও। সেসব তুলে দিন ভাগ্য বিড়ম্বিত জনমানুষের হাতে। তাতে চিরকালীন বৈষম্যের কতটা পরিবর্তন ঘটবে জানা নেই, কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন এমন চর্চার পর শীতের ওমটা আরেকটু আরামের মনে হবে। কে জানে লাল কার্ডিগানে হয়তো শুধু ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ পাবেন না আর, তাতে মিশে যাবে বিশুদ্ধ আনন্দের ঘ্রাণও! 

হারিয়ে যাওয়ার কথা

পাখি গাছের ডাল শীত
প্রিয় মানুষটির সাথে কুয়াশাঢাকা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হেঁটে যাওয়ার মূহুর্তও কি একরকম ‘হারিয়ে যাওয়া’ না?

শীতকে আমি আদর করে বলি ‘ভালোলাগার জীবন’। এইযে অকথ্য ঘাম নেই, জঘন্য হাঁটুজল নেই, পোড়ানো রোদ নেই….বরং অতি উৎসাহী মাফলারে গলা জড়িয়ে যেখানে খুশি হাজির হওয়ার দিন হলো শীত। দু-একদিনের ছুটি বা আস্ত একটা সপ্তাহ হাতে নিয়ে তাই সদলবলে কেউ বের হন পরিবারের সাথে, কারো সঙ্গী হয় প্রিয়মুখ বা বন্ধুদের দল। কানটুপি-জ্যাকেটের ভেতর ঢুকে পড়ে, হইহই করতে করতে ছুটে চলা – যাত্রাবিরতির সুযোগে কোনো এক অচেনা চায়ের দোকানে নেমে এক কাপ চা…আহা! চায়ের দাম ৫ টাকা বটে, তবে তাতে মিশে থাকা নিখাদ ভালোলাগার যে ঘ্রাণটুকু পৌঁছে গেলো আপনার মস্তিষ্কে – কথিত আছে সেটি নাকি এক্কেবারে ফ্রি! 

তবে না-ই বা গেলেন ভ্রমণে, না-ই বা মিললো মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দেয়ার ফুরসত, তাতে কী থেমে যাবে শীত উদযাপন? একদমই না! ইট-কাঠ-পাথরের এই শহরেও ‘হারিয়ে যাওয়া’ যায়। প্রিয় মানুষটির সাথে কুয়াশাঢাকা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হেঁটে যাওয়ার মূহুর্তও কি একরকম ‘হারিয়ে যাওয়া’ না? রোজকার ব্যস্ততাকে খানিকক্ষণের জন্য ছুটি দিন মস্তিষ্ক থেকে। তাকিয়ে দেখুন, গ্রিক মিথোলজির চরিত্র মনে হবে অতি পরিচিত পাশের জনকেও। এমনই নেশা শীতের বাতাসে। সাধারণকেও স্বপ্নীল করে তোলে এই শীত, দেয় হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা। 

চুলার পাড়ে উড়ছে ধোঁয়া 

শীত বড় শৌখিন ঋতু। এতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে রসনাবিলাসের কাব্য। আর এই কাব্যের উপস্থিতি বাড়ির রান্নাঘর থেকে শুরু করে গলির মোড়ের পিঠার দোকানে, বহুতল ভবনের ছাদ থেকে শুরু করে অভিজাত রেস্তোরাঁর মেন্যুতে। কোথাও পিঠাপুলির ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয় বাতাস, কোথাও বন্ধুরা দলবেঁধে আয়োজন করে নাগরিক জীবনে ভীষণ ট্রেন্ডি হয়ে ওঠা ‘বারবিকিউ নাইট’। 

এমনকি রোজকার খাবার তালিকায়ও বেশ ঘটা করে হয় পালাবদল। আলু-বেগুনের নিয়মিত তরকারির বদলে ফুলকপি-বাঁধাকপি-শিম-টমেটোর নিরামিষ জায়গা করে নেয় খাবার টেবিলে। ব্যস্ততা বাড়ে সবজি বিক্রেতাদের। শহুরে অলিতে-গলিতে পসরা সাজায় তারা। অফিসফেরত যাত্রায় হয়তো হুট করে একটা ফুলকপি কিনে ফেলেন কেউ কেউ! বাড়ি ফিরে বিব্রত মুখে আবদার করেন, ঝট করে না হয় একটু ফুলকপি-কইমাছ রেঁধে ফেলো! 

ছদ্মবেশী মায়া

শীতের সকাল নদী
স্মৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার এই ঋতুতে কারো কারো মনে পড়ে অসম্পূর্ণ গল্পগুলোও

একটু আগেই শীতকে বলেছি শৌখিন, ডেকেছি বৈষম্যপন্থী নামে। তবে শীত বোধহয় আসলে এক ‘ছদ্মবেশী মায়া’, যা ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরে ফেলে আসা অতীতকে। আমরা অনেকেই ফিরে যাই শৈশবের লাল টুপি মোড়ানো শীতের সকালগুলোয়। নিশ্চিন্ত নির্ভরতার সেইসব শীত মানে ছিলো বার্ষিক পরীক্ষা পরবর্তী শীতের ছুটি। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপের বদলে সেসব শীতে হাতে উঠতো শিবরামের হাসির গল্প বা সত্যজিতের বাদশাহী আংটি। স্মৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার এই ঋতুতে কারো কারো মনে পড়ে অসম্পূর্ণ গল্পগুলোও। নিজের অজান্তেই ব্যালকনিতে বসে ‘যা হতে পারতো, যা হয়নি’ আওড়াই আমরা। খুব বেশি ভাবতেও হয় না, সন্ধ্যায় যখন সোডিয়াম বাতির নিচে জমাট বাঁধতে শুরু করে কুয়াশা, তখন এক নিমেষে মন চলে যায় বহু বছর আগের কোনো শীত সন্ধ্যায়। সেইসব সন্ধ্যার ভালোলাগাটুকু কাউকে করে অনুপ্রাণিত, কারো জন্য হয় দীর্ঘশ্বাসের কারণ। 

তবে ব্যস্ত নাগরিক জীবনে স্মৃতিতে বাস করার ফুরসত খুব একটা মেলে না। তাই বর্তমানের উদযাপনকেই শেষমেশ বেছে নেই আমরা। শহরব্যাপী ধুম পড়ে যায় বিয়ের, প্রাণের টানে গাটছড়া বাধেন নবদম্পতিরা। কাচ্চির ঘ্রাণে ম-ম করে কমিউনিটি সেন্টারের বাইরের বাতাসও! স্যান্টার স্লেজ আর জিংগেল বেলে মুখরিত হয় শহর। কফিশপে ছড়িয়ে পড়ে ‘ফ্রেশলি ব্রিউয়েড’ কফির ঘ্রাণ। এ যেন রং-আলো-হাসির বুননে তৈরি এক ‘আনন্দনগরী’!

আমাদের শীতে তুষারের শুভ্রতা নেই, নেই বিরান বিস্তীর্ণ প্রান্তরের হাহাকার। তবু এখানে শীত নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করে অভিনব সৌন্দর্যে। ভোরের বাতাসে, মধ্যাহ্নের লাঞ্চবক্সে, বিকেলের কফিকাপে কিংবা সন্ধ্যার পিঠা উৎসবে এখানে নিজেকে মেলে ধরে শীত। শীত নিয়ে আপনার যত নস্টালজিয়া, যত ভালোলাগা- তা আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারেন কমেন্টস বক্সে। 

Write A Comment