Reading Time: 5 minutes

দু’মাস আগে তাহমিনা ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পান। যেহেতু তার পরিবার গ্রামে থাকেন, তাই ঢাকায় একা থাকা ছাড়া তাহমিনার উপায় নেই। তবে গত দু’মাসে হন্য হয়ে খুঁজেও বাসা ভাড়া করতে পারছে না সে। ভাড়া নিতে গেলে নানা রকম অপ্রীতিকর প্রশ্নের সম্মুখিন হচ্ছে সে, যেমন বিয়ে হয়েছে কিনা, শহরে একা থেকে চাকরি করার এতো কী দরকার, বিয়ে করে স্বামীকে নিয়ে থাকলেই তো হয়, ছেলেবন্ধু নিয়ে আসবে কিনা বাসায়, আরও কতকিছু। আবার শর্ত জুড়ে দিচ্ছে এই বলে, যে কোনভাবেই সন্ধ্যার পর বাসায় ফেরা যাবে না। তাই আপাতত একটি হোস্টেলে থাকাকেই সমাধান হিসেবে ধরে নিয়েছে সে, যদিও নিজের জন্য একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে সক্ষম।

একই রকম সমস্যায় পড়েছে মারুফ। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে নিজের একটি ছোট ব্যাবসা পরিচালনা করছে সে। যেহেতু তার দোকান তার পরিবারের বাসা থেকে বেশ দূরে, সেহেতু দোকানের কাছাকাছি নিজে থাকার জন্য একটি বাসা খুঁজছে সে গত এক মাস ধরে। তবে ব্যাচেলর শুনলেই বেশিরভাগ বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া দেবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাকেও অজস্র অপ্রীতিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রায়ই। বিয়ে করে বাসা ভাড়া নেবার উপদেশ তো আছেই।

চারপাশে খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাহমিনা বা মারুফের মতো আরও হাজারো ব্যাচেলর শহরে একা থাকার জন্য বাসা ভাড়া পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। চাহিদা যদিও বাড়ছে, সরবরাহ বাড়ছে না। তবে সমস্যাটা আসলে কতটা গুরুতর, এবং কেন? এই সমস্যার সমাধানই বা কী? এই সমস্ত প্রশ্নগুলোর উত্তরই খুঁজবো আজকের লেখায়।

ফ্ল্যাট ভাড়া
জনবহুল ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে নানা সমস্যার সম্মুখীণ হন সিঙ্গেলরা

সিঙ্গেলদের ভাড়া দিতে বাড়িওয়ালাদের অনীহা কেন  

মানুষের মৌলিক চাহিদা গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে বাসস্থান। তাই, খাদ্য ও বস্ত্র এই দুটির পরেই  সবচেয়ে জরুরি থাকার জন্য নিজের একটি জায়গা। সিঙ্গেলদের ক্ষেত্রেও এই চাহিদার গুরুত্ব ভিন্ন নয়। কিন্তু পরিবার নিয়ে থাকার জন্য বাসা ভাড়া নিয়ে ফেলা যতটা সহজ, একা থাকার ক্ষেত্রে কাজটি ততো সহজ হয় না। এর মূল কারণ হচ্ছে সিঙ্গেলদের প্রতি বহুকাল ধরে প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। 

যেহেতু তারা পরিবার থেকে আলাদা থাকেন, তাই অনেকেই ভাবেন সিঙ্গেলদের মাঝে দায়িত্বশীলতায় ঘাটতি রয়েছে। আবার শিক্ষার্থী হলে, বাড়িওয়ালাদের ভয় থাকে যে, যেহেতু তারা নিজে উপার্জন করে না, তাই বাসা ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে তারা হয়তো গড়িমসি করবে। আবার অনেকে ভাবেন, ব্যাচেলররা নেশাগ্রস্ত হয় ও নানা ধরনের অসামাজিক কাজে যুক্ত থাকে। তাই তাদেরকে ভাড়া দিলে নানা রকম পুলিশি ঝামেলার সম্ভাবনা আছে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, বাড়িওয়ালা সিঙ্গেলদের বাসাভাড়া দিলেও, প্রতিবেশীরা নানা রকম আপত্তি জানায়, কারণে- অকারণে অভিযোগ করে। তাই, সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবেও, বাড়িওয়ালাদের মাঝে সিঙ্গেলদের বাসা ভাড়া দিতে এক রকমের অনীহা দেখা যায়।

তবে, ক্ষেত্রবিশেষে এটাও সত্যি যে, কিছু কিছু সিঙ্গেল ভাড়াটিয়া বাসা ভাড়া নেয়ার পর নিজের খেয়াল খুশিমত কাজ করেন। বাসা ভাড়া নেয়ার সময় যে সমস্ত প্রতুশ্রুতি দিয়েছিলেন তা একদমই ভুলে যান। তাদের এসব খামখেয়ালির কারণে বাড়িওয়ালা বিরক্ত হোন, এবং পরবর্তীতে সিঙ্গেল ভাড়াটিয়া ভাড়া দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।  কিন্তু ভেবে দেখা দরকার, দায়িত্বহীন এমন ভাড়াটিয়ার সংখ্যা খুবই সীমিত। সীমিত সংখ্যক এই মানুষগুলোর কাণ্ডজ্ঞানহীনতার ফল বহন করতে হয় সমগ্র সিঙ্গেল ভাড়াটিয়াদের। তাই একথা অনুধাবন করা জরুরি যে, সিঙ্গেলদের বাসা ভাড়া সমস্যা কোনো একক সমস্যা নয়, আমাদের দেশে এটি একটি সামাজিক সমস্যা। 

ভাড়া বাসা
গুটিকয়েক মানুষের দায়িত্বহীনতার দায় পড়ে সকল সিঙ্গেল ভাড়াটিয়ার উপর

বাসা ভাড়া না পেয়ে যে সমস্ত বিড়ম্বনায় সিঙ্গেলরা  

ঢাকা শহরবাসীর শতকরা ৮০ শতাংশ মানুষই ভাড়া বাসায় থাকেন। এই অবস্থা যে শুধু রাজধানী ঢাকাতে তাই নয়, বরং অন্যান্য প্রধান নগরগুলিতেও। যেখানে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতে হলেই নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়, সেখানে সিঙ্গেলদের বাসা ভাড়া সমস্যা বা ভোগান্তির চিত্রটি যে কত ভয়াবহ, তা খুব সহজেই অনুমেয়।  

প্রতি বছর পড়াশোনা, চাকরির প্রস্তুতি কিংবা আরো বিভিন্ন প্রয়োজনে অসংখ্য ভাড়াটিয়া পাড়ি জমান ঢাকা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরে। যে কারণে প্রায় সর্বত্র ব্যাচেলর ভাড়া বাসার চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু চাহিদার তুলনায় ভাড়া বাসার যোগানটা খুবই সীমিত। ফলস্বরূপ দেখা যায়, বাসার মালিকেরা বেশিরভাগ সময়ই তাদের ভাড়াটিয়াদের উপর নানারকম দাবি জোরজবরদস্তি করে চাপিয়ে দেন। সিঙ্গেল ভাড়াটিয়া যাচাই করার নামে নানা রকম আপত্তিকর প্রশ্ন করে বসেন।  

এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই সিঙ্গেল ভাড়াটিয়াদের হাতে আর কোনো উপায় থাকে না। তারা এমন আপত্তিকর পরিস্থিতি চুপচাপ মেনে নেন কেবল একটি ভাড়া বাসার আশায়। বিনাবাক্যব্যয়ে তারা বাড়ির মালিকের দাবি করা বাড়তি ভাড়াসহ সকল অন্যায্য দাবি কিংবা শর্তও মেনে নিতে বাধ্য হন। 

কিন্তু এতো কিছুর পরেও, বাসা ভাড়া না পেয়ে অসংখ্য সিঙ্গেল মানুষ খুঁজতে থাকেন কম খরচে বসবাসের জন্য বিকল্প উপায়। অনেকেই বাধ্য হয়ে, মেস কিংবা হোস্টেলে ঠিকানা খুঁজে নেয়। কিন্তু, সীমিত পরিসরের এই জায়গাগুলোতে চাইলেই নিজের মতো করে থাকা যায় না, জীবন যাপনের তাল ও লয়ের ছেদ ঘটে অনায়াসেই।  যার ফলে  বাস্তব পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে সিঙ্গেলদের জন্য। কখনো কখনো এই মানসিক চাপ এতোটাই সীমা ছাড়িয়ে যায় যে, পড়াশোনা ও কর্মজীবনও নানা ভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। 

সিঙ্গেল ভাড়া বাসা
বাসা ভাড়া না পেয়ে অসংখ্য সিঙ্গেল মানুষ খুঁজতে থাকেন কম খরচে বসবাসের জন্য বিকল্প উপায়

কীভাবে আসবে সমাধান

সিঙ্গেলদের বাসা ভাড়া সমস্যা এর সঠিক সমাধান আনতে হলে, সবার আগে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোটা জরুরি। সাথে জরুরি সিঙ্গেলদের প্রতি সাধারণ মানুষের গতানুগতিক ধারণার পরিবর্তন। আর এটি করতে হলে আওয়াজটা আসতে হবে সিঙ্গেলদের কাছ থেকেই। তাদেরকেই নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার হতে হবে এবং তা সবাইকে জানাতে হবে।  

এক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া হতে পারে চমৎকার একটি প্ল্যাটফর্ম। সিঙ্গেলদের বাসা ভাড়া সমস্যা, অভিযোগ, এবং নিজেদের বাসা ভাড়া নেয়ার ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতার কথা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টুইটারের মতো জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম গুলোতে জানাতে হবে। তাহলে, সিঙ্গেলদের বাসা ভাড়া সমস্যা যে একজন বা দুইজন বাড়িওয়ালারাও অনুধাবন করতে পারবেন সিঙ্গেলদের বাসা ভাড়া সমস্যার ব্যাপকতা। 

বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়া দুই পক্ষের জন্যই, বাংলাদেশে জারি রয়েছে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১। এই আইন অনুযায়ী । সিঙ্গেলদের বাসা ভাড়া সমস্যার সমাধানেও কিন্তু এই লিখিত চুক্তিপত্রটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে ভাড়াটিয়ার সমস্ত তথ্য সম্পর্কে বাড়িওয়ালা নিশ্চিত থাকতে পারবেন। অন্যদিকে, অহেতুক প্রশ্নের চাপে একজন সিঙ্গেল ভাড়াটিয়াকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না। লিখিত চুক্তি থাকায়, ভাড়াটিয়া হিসেবে নিজেদের  দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কেও তারা সতর্ক থাকবেন। এতে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার পারস্পরিক ভুল বুঝাবুঝি কমবে, সেইসাথে সিঙ্গেলদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টাবে

লিখিত চুক্তিপত্র
ভাড়াটিয়ার সাথে বাড়িওয়ালার একটি লিখিত চুক্তিপত্র থাকতে হবে

সিঙ্গেলদের বাসা ভাড়া সমস্যা লাঘব করতে বিপ্রপার্টি এর মতো স্বনামধন্য রিয়েল এস্টেট কোম্পানিও হাতে নিয়েছে চমৎকার কিছু উদ্যোগ। সিঙ্গেলদের বাসা ভাড়ার চাহিদা মেটাতে তাদের বিশাল ডাটাবেজে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে সিঙ্গেলরা ভাড়া নিতে পারবেন এমন বাসার লিস্টিং। ফলে, বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার ভুল বুঝাবুঝি দূর করা যাচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সমঝোতার মাধ্যমে। এমন উদ্যোগগুলোও কিন্তু সিঙ্গেলদের বাসা ভাড়া সমস্যা সমাধানের কাজটিকে সহজ করে দিচ্ছে অনেকখানি।  

আসলে সিঙ্গেলদের বাসা ভাড়ার সুযোগটি নিশ্চিত করতে, বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার ভুল বুঝাবুঝি দূর করা সব থেকে জরুরি। এর জন্য দায়িত্ববান হতে হবে উভয়পক্ষকেই। যার যার জায়গা থেকে শ্রদ্ধাশীল ও পরিণত আচরণ করলে এ সংকট কেটে যাবে অনেকখানি। 

সিঙ্গেল হিসেবে বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে জীবনের কোনো না কোনো ধাপে আপনিও কি কোনো আপত্তিকর পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছেন? তাহলে বাসা ভাড়ার সেই অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করুন মন্তব্যের ঘরে।  

Write A Comment

Author