Reading Time: 4 minutes

পদ্মাপাড়ের জেলা রাজশাহী ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্রে অনন্য। সবুজের ছায়ায় গড়ে ওঠা পরিচ্ছন্ন এ জেলাটি ভীষণ শান্তও বটে! সেইসাথে ফলের মহা সম্ভার আর রেশম শিল্পের উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের ফলে এ জেলাটিকে অপার সম্ভাবনার শহর বললেও ভুল হবে না। তবে রাজশাহীর প্রিয় বিষয়গুলো কী কী তা কি আপনারা জানেন? সেসব জানাতেই আমাদের আজকের ব্লগ। আসুন তবে জেনে নেই রাজশাহী কেন আমার এত প্রিয়!  

রাজশাহীর জীবনযাত্রা 

মাছ ধরা
রাজশাহী জেলার অনেক মানুষই জীবিকার জন্য পদ্মার ওপর নির্ভরশীল

অধিবাসীদের জীবনাচরণ, প্রচলিত প্রথা আর আচারের মাঝেই জায়গাটিকে সবচেয়ে ভালোভাবে চেনা যায়, জানা যায়। রাজশাহীর প্রিয় বিষয়গুলো এর মধ্যে অন্যতম এখানকার মানুষের আন্তরিকতা আর সহৃদয়তা। রাজশাহী গেলে তাই এখানকার মানুষের আতিথেয়তা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। এছাড়া রাজশাহীবাসীর জীবনযাপনের ধরণ বেশ সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর। ‘শিক্ষানগরী’ হিসেবে পরিচিত এ জেলার মানুষের শিক্ষা সচেতনতাও বেশ প্রশংসনীয়। এ এলাকার মানুষের জীবন আবর্তিত হয় মূলত তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে; আর সেগুলো হলো পদ্মা নদী, ফলের রাজা আম আর রেশম শিল্প। পদ্মাপাড়ের অববাহিকায় বাস করার ফলেই বোধহয় এখানকার মানুষ এমন নম্র ও সাধারণ। এ জেলার অনেক মানুষই জীবিকার জন্য পদ্মার ওপর নির্ভরশীল। কেউ কেউ জড়িত কৃষিকাজ, বাণিজ্য ও চাকরির সাথেও। আম-লিচু ফলন, প্রক্রিয়াজাতকরণও অনেকের কর্মসংস্থানের উৎস। এ জেলার জীবনযাত্রার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ রেশম শিল্প। রেশমপোকা থেকে সুতার গুটি সংগ্রহ, কারখানায় সুতার বয়ন ও বুননের সাথে পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি অনেক নারী কারিগরও কাজ করছেন দক্ষতার সাথে। রাজশাহীর প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও অধিবাসীদের সচেতনতার ফলেই জেলাটিকে এমন সবুজ ও পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব হয়েছে। রাজশাহীর প্রিয় বিষয়গুলো এর মধ্যে এ বিষয়টিও কিন্তু লক্ষণীয়। 

রাজশাহীর যাতায়াত 

আমার প্রিয় জেলা সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে আমরা কথা বলেছিলাম খুলনার মসৃণ রাস্তা নিয়ে রাজশাহীর রাস্তাও কিন্তু তেমনই মসৃণ ও পরিকল্পিত। এ জেলার মসৃণ রাস্তা ধরে, নিরিবিলি শহরের মাঝখান দিয়ে কিংবা পদ্মাপাড়ের বাঁধ ধরে যখন এগোবেন আপনি, সত্যিই জুড়িয়ে যাবে মন! বিশেষ করে আমরা যারা ঢাকাবাসী, অর্থাৎ কোলাহল আর খানাখন্দে ভরা রাস্তায়ই জ্যামে বসে দিনতিপাত করি যারা, এমন দারুণ রাস্তার জেলায় প্রশান্তির সন্ধানে যেতেই পারি। শহরের ভেতর চলাচলের জন্য এখানে পাবেন অপেক্ষাকৃত আধুনিক ও আরামদায়ক নকশার রিকশা ও টেম্পো। এছাড়া দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাস, ট্রেন বা বিমানযোগে এ জেলায় পৌঁছাতে পারবেন আপনি।  

রাজশাহীতে যা যা দেখবেন 

উত্তরের জেলা রাজশাহীতে রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। গ্রীষ্মকালে গাছে গাছে কাঁচা-পাকা আম দেখেও নিখাদ আনন্দ পান। প্রাচীন ইতিহাসের নিদর্শন দেখতে চাইলে যেতে পারেন পুঠিয়া রাজবাড়ি ও বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো জাদুঘর বরেন্দ্র জাদুঘরে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাতে চাইলে বিকেল বা সন্ধ্যা নামার মুহুর্তটি কাটিয়ে দিতে পারেন পদ্মাপাড়ে। ছুটির দিনে পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটানোর জন্য রাজশাহীবাসীর কাছে পদ্মার তীরের টি-বাঁধ ভীষণ জনপ্রিয়। এছাড়া রাজশাহীতে ঘুরতে গেলে বিসিক শিল্প নগরী ঘুরে আসতে ভুলবেন না। পোকা থেকে রেশম তৈরির কলাকৌশল দেখতে পাবেন এখানে। তুলনামুলক কম দামে এখান থেকে রেশমের কাপড়ও কেনা যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াঘেরা ক্যাম্পাসটি শহরের সৌন্দর্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এখানে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ এবং দেশের ছাত্রজনতার অর্থ সাহায্যে শিল্পী নিতুন কুন্ড কর্তৃক বিনা পারিশ্রমিকে নির্মিত ভাস্কর্য ‘সাবাশ বাংলাদেশ’। রাজশাহী জেলার উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যগুলোর কথা বলতে গেলেই অবশ্যই বলতে হয় ‘স্মৃতি অম্লান’ এর কথা। নীল শুভ্রপাথরের আচ্ছাদনে ঘেরা এ স্মৃতিস্তম্ভটি শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থলেই অবস্থিত। জেলা সদর থেকে খানিকটা দূরের বাঘা মসজিদটিও কম নান্দনিকতার পরিচয় বহন করে না। টেরাকোটা ও স্থাপত্যশৈলীর উৎকর্ষতায় পঞ্চদশ শতাব্দীর এ মসজিদটি অনন্য। ‘বড়কুঠির’ নামে অভিহিত প্রাচীন ওলন্দাজ ফ্যাক্টরী এবং হজরত শাহ্ মখদুমের সমাধি সৌধও দেখবার মতো জায়গা।

রাজশাহীর খাবার-দাবার 

সিঙ্গারা-সমুচা
রাজশাহীর সাহেব বাজারে পাবেন অঞ্চল বিখ্যাত বিদ্যুতের দোকানের কলিজার সিঙ্গারা ও খাসির সমুচা

রাজশাহীতে বেড়াতে গেলে ঘোরাঘুরির পাশাপাশি এখানকার সুস্বাদু খাবারের স্বাদ নিতেও ভুলবেন না।  রাজশাহীর সাহেব বাজারে পাবেন অঞ্চল বিখ্যাত বিদ্যুতের দোকানের কলিজার সিঙ্গারা ও খাসির সমুচা। মিষ্টিপ্রেমীদের জন্য রয়েছে মিষ্টান্ন ভান্ডারের কমলাভোগ আর রানার দোকানের টাটকা রসে ডুবানো মিষ্টি। রাজশাহী কোর্টের সামনে আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবেন এ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ খাবার ‘কালাই রুটি’, যার প্রধান উপকরণ মাষকলাই ডাল। 

নদীর তীরবর্তী এ জেলার মানুষ স্বভাবতই মাছ খেতে ভীষণ ভালোবাসে। পদ্মার ইলিশ থেকে শুরু করে পিউলি, বাতাসি নামের বিভিন্ন ছোটমাছ এখানে খুব ভালো পাওয়া যায়।  

রাজশাহীর নদী

পদ্মায় নৌকা ভ্রমণ
পদ্মায় নৌকা ভ্রমণ আপনার মন ভালো করে দেবে নিমেষেই!

পদ্মাই রাজশাহীর প্রধান নদী, যেখান থেকে শাখা হিসেবে উৎপত্তি হয়েছে মহানন্দা ও পুনর্ভবার। পদ্মায় নৌকা ভ্রমণ আপনার মন ভালো করে দেবে নিমেষেই! বিশেষ করে বর্ষা মৌসুম এলেই রাজশাহীতে প্রমত্তা হয়ে ওঠে পদ্মা। রাজশাহীর প্রিয় বিষয়গুলো মাঝে এটি অন্যতম। এ সময় নদীতে ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনাও বেড়ে যায়। সারি সারি ডিঙ্গি ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে ভ্রমণে বের হয় অসংখ্য মানুষ। আবার নদীর তীরে অলস বিকেল কাটাতে ছুটে আসেন শহরবাসী, বসে মিলনমেলা। 

ফলের রাজা আম 

আম
বাহারি আর সুস্বাদু আমের কথা বললে সবার আগে আসে রাজশাহীর নাম

রাজশাহীর প্রিয় বিষয়গুলো এর মধ্যে বাহারি আর সুস্বাদু আম সবচেয়ে চমৎকার। রাজশাহীর বিখ্যাত আম দেশের সব অঞ্চলে সমান সমাদৃত। গত তিন বছর ধরে ইউরোপের বাজারেও রপ্তানি হচ্ছে রাজশাহীর উৎপাদিত আম। গুটি জাতের আম থেকে শুরু করে গোপালভোগ, লক্ষণভোগ, রানীপসন্দ, ক্ষিরসাপাত বা  হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি ও ফজলি- সবই পাবেন রাজশাহীতে। জুন-জুলাইতে রাজশাহী ভ্রমণ করলে রাজশাহীর হাটে-বাজারে-গ্রামে-শহরে পাবেন আমের মেলা। মনে হবে ঠিক যেন আমের রাজ্যে এসে পৌঁছেছেন আপনি!  

কোলাহল থেকে দূরে, পরিকল্পিত এ জেলায় কিছুদিন ঘুরে আসলে সত্যিই পাবেন প্রশান্তির ছোঁয়া। পদ্মাপাড়ের এ শান্ত অঞ্চলটি তাই একবার ঘুরে আসতেই পারেন! কথা দিচ্ছি, রাজশাহীর সৌন্দর্য আপনাকে একেবারেই নিরাশ করবে না! 

Write A Comment