Reading Time: 4 minutes

চলমান মহামারীর প্রকোপে বিপর্যস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে জনজীবনের সবগুলো পর্যায়। অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যখাতে এ বিপর্যয় সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এক চীন ছাড়া সব বড় অর্থনীতিই সংকুচিত হয়েছে। কিন্তু এমন ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেট সেক্টর ধ্বসে পড়েনি, বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও উন্নতির গ্রাফকে উর্ধ্বমুখী রেখেছে এ সেক্টর। কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেট সেক্টর এর উন্নতির প্রভাবক গুলোই আমাদের আজকের ব্লগের মূল প্রতিপাদ্য। 

ই-কমার্সের ক্রমবর্ধমান চাহিদা

হিসাব
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ই-কমার্স সেক্টরেও এ বছর লেনদেন হয়েছে স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি

কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেট সেক্টর এর উন্নতির প্রভাবক গুলোর কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসবে ই-কমার্সের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কথা। বিশ্বায়ন ও তথ্য প্রযুক্তির জয়যাত্রার এ যুগে স্বভাবতই এর প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতা বাড়ছিলো। আর মহামারীর এ সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবনযাপন করার তাগিদে ই-কমার্স হয়ে উঠেছে এক আবশ্যক প্রয়োজনীয়তা। 

যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারি ব্যুরোর রিপোর্ট মতে, এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশটির রিটেইল ই-কমার্স থেকে আয় হয়েছে ২১১.৫ বিলিয়ন ডলার, যা পূর্ববর্তী প্রান্তিকের রিটেইল ই-কমার্সের আয়ের চেয়ে ৩১.৮% বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে রিটেইল ই-কমার্স ভিত্তিক আয় হবে ৪৪.৫% । অর্থাৎ ব্যয়কৃত প্রতি ৫ ডলারের ১ ডলার ব্যয় হবে ই-কমার্সে। শুধু উন্নত দেশেই যে ই-কমার্সের চাহিদা বেড়েছে তা কিন্তু নয়, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ই-কমার্স সেক্টরেও এ বছর লেনদেন হয়েছে স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, জুন ২০২০’এ এই সেক্টরে লেনদেনকৃত মোট অর্থের পরিমাণ ছিলো ৪৯১.৪ কোটি, যা বৃদ্ধি পেয়ে জুলাই ২০২০ এ হয়েছে ৬৪০.৪ কোটি টাকা।  

প্রাইসওয়াটার হাউস কুপার্স বা পিডব্লিউসি’র রিপোর্ট অনুযায়ী, ৬২% ক্রেতা অনলাইনে অর্ডার করবার দুই দিনের মধ্যে পণ্যটি হাতে চান। এমন চাহিদার কারণে ‘লাস্ট মাইল ডেলিভারি সার্ভিস’ নিশ্চিত করতে প্রতিটি মেট্রোপলিটন ও উন্নয়নশীল শহরে গড়ে তোলা হচ্ছে ওয়্যারহাউজ ও ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার। আর এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেট সেক্টরে দুভাবে। প্রথমটি হলো, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিয়েল এস্টেট অর্থাৎ স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি, ওয়্যারহাউজ, ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারের চাহিদা এখন অন্য যেকোনো সময়ের চাইতে বেশি। দ্বিতীয় প্রভাবটি হলো, রিটেইল সেন্টারের মধ্যে রেস্টুরেন্ট, শপিং সেন্টার ইত্যাদির চাহিদা মহামারীর কারণে এখনো পড়তির দিকে। 

রিটেইল স্টোরের চাহিদার গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন 

শপিং মল
রিটেইল স্টোরের চাহিদা কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেট সেক্টরে এখন অনেক কম

 আগে বলেছি, রেস্টুরেন্ট, শপিং সেন্টার ইত্যাদি রিটেইল প্রপার্টির চাহিদা কমেছে অনেকটাই। কিন্তু মেডিসিন স্টোর, গ্রোসারি শপ বা সুপারশপের চাহিদা কিন্তু এখনও ক্রমবর্ধমান। কেননা ঔষধ, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চাহিদা একেবারেই কমেনি এবং জুলাই-আগস্টের পর বেশ কিছু দেশ থেকে ‘লকডাউন’ তুলে নেয়া হয়েছে। ফলে এ ধরনের রিটেইল স্টোরের চাহিদা এখনো বেশি। অনেকেই ই-কমার্স ও গ্রোসারি শপকে এক ছাতার নিচে নিয়ে এসে এ ব্যবসা শুরু করেছেন। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার তথ্যমতে, এপ্রিল-জুন ২০২০ এর তুলনায় সেপ্টেম্বর ২০২০ এ সুপারশপগুলোতে ফুটস্টেপ বা মানুষের পদচারণা অন্তত ১৩%-১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। 

তবে এ কথাও সত্যি যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়া অন্যান্য পণ্য যেখানে বিক্রি হয়, বিশেষত বিলাসবহুল পণ্যের রিটেইল স্টোরের চাহিদা কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেট সেক্টরে এখন অনেক কম। কিন্তু তাও কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেট সেক্টর এর উন্নতির প্রভাবক এর মধ্যে প্রয়োজনীয় রিটেইল স্টোরের চাহিদার গতি পরিবর্তনের ব্যাপারটি উল্লেখযোগ্য।  

অফিস স্পেসের চাহিদার রকমফের

বিল্ডিং
অফিস স্পেসের নকশায় পরিবর্তনের ঢেউ আসবে শীঘ্রই

অফিস স্পেস যে শুধু কাজ করবার জায়গা তা-ই নয়। অফিস স্পেস যেকোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচায়ক, যা একদিকে প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরিতে সহায়ক এবং অন্যদিকে এমপ্লয়িদের প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতেও ভূমিকা রাখে। তাই সুপরিকল্পিত, সুসজ্জিত অফিস স্পেস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

মহামারীর আঘাতে জনজীবনের অন্যান্য দিকের মতো পাল্টেছে কর্মজীবনও। শুরুর দিকে প্রায় সব দেশেই চলছিলো ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ এর রীতি। ফলে সিবিআরআই নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম অভিমত দিয়েছিলো যে, এ বছর বিশ্বে অফিস স্পেসের চাহিদা ১% কমে যাবে- যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ চাহিদা হবে ২% এবং অফিস স্পেসের ভাড়া ৩% থেকে ৬% কমে যাবে । এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ রিয়েল্টরসের রিপোর্ট অনুযায়ী, জুলাইতে অফিস প্রপার্টির চাহিদা কমেছে ৬৭%।  কিন্তু এ ধারণার উল্টোচিত্র দেখা যায় দুধরনের দেশে। ভারতের মতো কিছু উন্নয়নশীল দেশে এখনো কমেনি করোনার প্রকোপ, কিন্তু তবুও কর্মজীবনে ফিরে গেছে তারা। যেমন ভারত, পৃথিবীর আউটসোর্সিংয়ের শীর্ষস্থানীয় দেশ হওয়ায় এখানে অফিস স্পেসের চাহিদা বাড়ছেই। এমনকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও অফিস নিচ্ছে এখানে। এছাড়া জাপান, কোরিয়া, চীনসহ পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে, নিউজিল্যান্ডসহ ইউরোপের কিছু দেশে এখনো অফিস স্পেসের চাহিদা বাড়ছে। এদের মধ্যে কিছু দেশে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রায় নেই বললেই চলে এবং জীবনযাত্রায় ফিরে এসেছে মহামারী পূর্ববর্তী সুর, আবার কিছু দেশে ভাইরাসের সংক্রমণ না কমলেও চলছে বাণিজ্যিক কর্মকান্ড।

বলা হচ্ছে, এসব দেশে অফিস স্পেসের নকশায় পরিবর্তনের ঢেউ আসবে শীঘ্রই। সম্প্রতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ‘ওপেন স্পেস’ পদ্ধতিতে সাজানো অফিসে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা কঠিন। ফলে ‘কম্পার্টমেন্টালাইজড স্পেস’ বা ‘কিউবিকল’ এর চাহিদা বাড়বে বলে অনেকে ধারণা করছেন। নকশার পরিবর্তনের কথা আলোচনায় উঠে এলেও অফিস স্পেসের চাহিদা এখন আর কম না হওয়ায় কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেট সেক্টর এর উন্নতির প্রভাবক এর মধ্যে এটি একটি। 

লাভজনক বিনিয়োগের সুযোগ 

হাত মেলানো
রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগের নানা রকমফেরের মধ্যে কমার্শিয়াল স্পেসে বিনিয়োগ থেকে সবচেয়ে বড় অংকের রিটার্ন পাওয়া যায়

লকডাউনের সময় কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেট ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ কমে গিয়েছে অনেকটাই। কিন্তু এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগের নানা রকমফেরের মধ্যে কমার্শিয়াল স্পেসে বিনিয়োগ থেকে সবচেয়ে বড় অংকের রিটার্ন পাওয়া যায়। কমার্শিয়াল স্পেস থেকে বার্ষিক রিটার্ন পাওয়া যায় ৬% থেকে ১২%। অথচ তুলনা করলে দেখা যায়, রেসিডেনসিয়াল প্রপার্টি থেকে বার্ষিক রিটার্ন পাওয়া যায় মাত্র ১% থেকে ৪%।

মহামারীর কারণে ক্ষণিকের জন্য অবদমিত হয়েছিলো কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেট সেক্টরের উন্নয়ন। তবে দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এ সেক্টর, আবারও দেখছে উন্নয়নের ধারা। আর কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেট সেক্টর এর উন্নতির প্রভাবক হিসেবে নানা রকম কমার্শিয়াল স্পেসের চাহিদার ধরন বদলানো একটি বড় কারণ। এ ব্যাপারে আপনার মূল্যবান মতামত জানাতে চাইলে তা কমেন্টস বক্সে লিখতে একদম ভুলবেন না! 

Write A Comment