Reading Time: 4 minutes

বাংলাদেশে প্রায় ১০৪৮ প্রজাতির গাছ রয়েছে, যার মধ্যে ৪৩২ প্রজন্ম এবং ৯৯ গোত্রের জিমনোস্পার্মস এবং অ্যাঞ্জিওস্পার্মের গাছ রয়েছে। যেসব গাছের কাঠের বাণিজ্যিক মূল্য রয়েছে, সেসমস্ত গাছকে সাধারণত কাঠ গাছ বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রধান দুই ধরনের কাঠ রয়েছে, যার একটি নরমকাঠ এবং অন্যটি শক্তকাঠ হিসেবে পরিচিত। কাঠের রকমভেদ হিসেবে নরমকাঠের মূল উৎস হিসেবে থাকে  জিমনোস্পার্মস উদ্ভিদ এবং অ্যাঞ্জিওস্পার্ম উদ্ভিদ মূলত শক্ত কাঠের প্রধান উৎস। যেকোনো দেশের ক্ষেত্রেই কাঠের ব্যবহার অনেক বেশি হয়ে থাকে, যা সে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলে এবং বিশাল গুরুত্ব বহন করে।    

বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ প্রজাতির কাঠ গাছ প্রাকৃতিক ভাবে বনাঞ্চলে এবং কৃত্রিমভাবে বাড়িঘরে জন্মে থাকে। এর মধ্যে বেশিরভাগ শক্ত এবং মজবুত কাঠ হলেও, পার্থক্য হিসেবে রয়েছে বনস্পতি বা বাঁশপাতা গাছ। তবে বাংলাদেশে দেখা যায় এমন অন্যান্য কাঠ গাছের মধ্যে রয়েছে বাবলা, ছাতিম, বইলাম, গর্জন, সুন্দরি, শাল, মেহগনি, শিমুল ইত্যাদি গাছ।   

কন্সট্রাকশন, ফার্নিচার, পেপার পাল্প, জ্বালানি, অ্যারোমেটিক, মেডিসিন, রাবার, কসমেটিকস ইত্যাদি বিভিন্ন সেক্টরে কাঠের ব্যবহার হয়ে থাকে। কোন গাছ থেকে কী ধরনের কাঠ পাওয়া যায় তার উপর নির্ভর করে কোন ধরনের কাজের জন্য কী ধরনের গাছের কাঠ ব্যবহার করা সঠিক হবে। তবে চলুন এবার জেনে নেয়া যাক বাংলাদেশে যে সমস্ত কাঠ পাওয়া যায় তার রকমভেদ এবং কোনটি কী উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় এর বিস্তারিত সম্পর্কে।    

ফার্নিচার বানানোর জন্য কাঠের ব্যবহার 

চাপালিশ, গামারি, সিল করই, জারুল এবং সেগুন ইত্যাদি গাছ সমূহ দিয়ে সাধারণত ঘরের বিভিন্ন ধরনের ফার্নিচার তৈরি করা হয়। কাঠের রকমভেদ এর মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত কারণে এ ধরনের কাঠ বেশ শক্ত এবং মজবুত হওয়ার কারণে ঘরের দরজা, জানালা, কেবিনেট, টেবিল এবং চেয়ার বানানোর জন্য এ সমস্ত গাছের কাঠ ব্যবহার করা হয়। ঘরের সাজে আভিজাত্য ফুটিয়ে তুলতে তাই বানিয়ে নিতে পারেন বাহারি নকশার কাঠের আসবাব। 

আর কাঠের এই আসবাবের যত্ন নেয়াও কিন্তু চাট্টিখানি কথা না। অনেক সময়ই ঠিকঠাক মতো যত্ন না নেয়ার ফলে কাঠের বার্নিশ চলে যায়। এমনকি কাঠে ঘুণপোকা ধরার সম্ভাবনাও থাকে। তাই ঠিকঠাক মতো কাঠের যত্ন নিতে হবে।

যন্ত্রপাতি বানানোর জন্য কাঠের ব্যবহার 

Wooden Furniture
বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র রয়েছে যা সরাসরি কাঠ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়

নৌকা এবং লঞ্চ বানানোর জন্য সাধারণত সেগুন, জারুল এবং সুন্দরি গাছ ব্যবহার করা হয়।  লাঙল এবং কার্ট বানানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে দারুণ কাজ করে বাবলা কাঠ। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের কাজের জন্য স্থানীয় কাঠের ব্যবহার করতেও দেখা যায়।  

কন্সট্রাকশন শিল্পে কাঠের ব্যবহার 

ইলেকট্রিক লাইনের পোল বানানোর জন্য একসময় বাংলাদেশে কাঠ ব্যবহার করা হতো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কাঠের এই পোলের বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে কংক্রিট। তবে পণ্যের দীর্ঘ স্থায়িত্ব লাভের জন্য এক ধরনের প্রিজারভেটিভ  ট্রিটমেন্ট এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয়। এমন ধরনের আরও পণ্যের জন্য   গ্রামীণ ইলেক্ট্রিফিকেশন বোর্ড হচ্ছে সবচেয়ে বড় গ্রাহক। সুন্দরি, সেগুন, গর্জন, তালি, কাঙ্করা ইত্যাদি গাছগুলো মূলত পোল বানানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে রেলওয়ে স্লিপারস বানানোর জন্য প্রধানত গর্জন গাছের ব্যবহারই বেশি হয়ে থাকে।       

শিল্পখাতে কাঠের ব্যবহার 

কৃত্রিম কাঠের একটি নির্দিষ্ট ধরন উৎপাদনের জন্য কারখানায় অনেক কাঠ গাছই প্রক্রিয়াজাত করা হয়। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হার্ডবোর্ড এর কথা। খুলনা হার্ডবোর্ড মিলে সুন্দরি গাছের কাঠ পিষে এবং সংকুচিত করে এর থেকে হার্ডবোর্ড বানানো হয়। এছাড়া ম্যাচ বাক্স বানানোর জন্য বাংলাদেশের বেশ কিছু ছোট ছোট কারখানায় এক ধরনের কাঠের পাতলা তক্তা ব্যবহার করা হয় যা মূলত ভিনিয়ার নামে পরিচিত।  আর কাঠের এই তক্তা গুলো নেয়া হয় কদম, শিমুল এবং চাতিম নামের গাছ  থেকে। তবে ম্যাচ বাক্স ছাড়াও, প্লাইউড বানানোর ক্ষেত্রেও এ ধরনের পাতলা তক্তা প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সাধারণত সিলিং, পার্টিশন এবং প্যাকিং বাক্স বানানোর জন্য প্লাইউড ব্যবহার করা হয়। আর তাই বলতেই হয়, বাংলাদেশে কাঠের শিল্প মূল্য অনেক বেশি।     

Forest Area
বাংলাদেশের শিল্পখাতে কাঠের বিশাল চাহিদা রয়েছে

উডটেক্স বানানোর জন্য স্বল্প মূল্যের এই কাঠ গাছগুলো ব্যবহার করা হয়। তবে এর জায়গায় যদি পাটের কাঠি ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে এর নামকরণ করা হয় পারটেক্স। পারটেক্সের এই বোর্ডগুলো বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় পাতলা তক্তা বা ভিনিয়ার দিয়ে সাজানো হয়। আর এই তক্তাগুলো নেয়া হয় গর্জন, সেগুন, চম্পা এবং চাপালিশ কাঠ থেকে।  

তবে স্বল্প মূল্যের এই ভিনিয়ার গুলো ব্যবহারের সাধারণ উদ্দেশ্য হলো খরচ কমিয়ে রাখা। সূক্ষ্ম এবং আকর্ষণীয় পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সেগুন বা সেগুন চাম্বুল ব্যবহার করা হয়।  এ ধরনের পণ্যের আকর্ষণীয় গঠন, দানা এবং বৈশিষ্ট্যের কারণে এগুলো অনেক ব্যয়বহুল হয়ে থাকে। আকর্ষণীয় ফ্ল্যাশ ডোর, পার্টিশন, টেবিলটপ ইত্যাদি বানানোর জন্য এ ধরনের কাঠের ব্যবহার বেশি হয় থাকে। তবে সেগুন চাম্বুল বিশেষভাবে শুধুমাত্র পাতলা তক্তা বা ভিনিয়ার এর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কাঠের আসবাব ব্যবহার করার পাশাপাশি এর যত্ন নেয়াও অনেক জরুরি। বিশেষ করে বর্ষাকালে স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়াতে কাঠের আসবাব অনেক সময় ফুলে উঠে। তাই অন্যান্য সময়ের পাশাপাশি বিশেষ করে বর্ষাকালে কাঠের আসবাবের যত্ন নেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।  

ভেষজ এবং ঔষধি পণ্যের জন্য কাঠ  

Herbal Products
রাসায়নিক প্রসাধনীর বদলে এখন ভেষজ পণ্যের ব্যবহার অনেক বেড়ে গিয়েছে

বিভিন্ন ধরনের ভেষজ এবং ঔষধি পণ্যের উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশে কয়েক ধরনের কাঠ রয়েছে। ভেষজ গাছের রয়েছে অনেক ধরনের  কার্যকারিতা, এর মধ্যে সুগন্ধি, কসমেটিকস, প্রিজারভেটিভস, কীটনাশক, ডাই, ওষুধ অন্যতম। অ্যারোমেটিক পণ্য তৈরিতে আগর গাছের কাঠ বিশ্বজুড়ে বেশ জনপ্রিয়। অর্জুন, তুলসী, থানকুনি, করই, খলিশা, কেউয়া কাটা, পাসুর ইত্যাদি গাছের মতো অনেক গাছ বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ধরনের গাছগুলোর রয়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রার ঔষধি মূল্য। আর তাই যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিকারের উৎস হিসেবে এই গাছগুলো ব্যবহার করে আসছে। 

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কাঠ গাছ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। স্থানীয় মানুষ এবং উদ্যোক্তাদের জন্য এটি আয়ের অন্যতম একটি উৎস হিসেবে কাজ করে। তাই ব্যাপক হারে গাছ কাটা এড়াতে সেখানকার মানুষ এবং এ ধরনের ব্যবসায়ের সাথে জড়িত শিল্পগুলোর অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি নিজস্ব ব্যবসায়ের প্রয়োজনে কাঠের উৎসের সন্ধান নিয়েও ভাবা উচিত এবং পরিবেশের স্বার্থ সচেতনতার দিকটিও গুরুত্বের সাথে নেয়া উচিত। 

Write A Comment

Author