Reading Time: 6 minutes

প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে এমন অনেক কিছুই সম্ভব হচ্ছে যা কিছুদিন আগেও ছিল কল্পনা। মোবাইল অ্যাপেই এখন মিলছে বাসের টিকেট, রাইড শেয়ারিং, ঘর গৃহস্থালীর বিভিন্ন সার্ভিস এমনকি অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতামতও। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে কিছু স্টার্ট আপ কোম্পানি তাদের যুগান্তকারী আইডিয়া এবং সাহস নিয়ে এগিয়ে আসার ফলেই। এইতো, সেদিনকার স্টার্ট আপ কোম্পানি পাঠাও এখন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বাইরেও অপারেশন শুরু করেছে, তাদের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফিচারড হয়েছেন ফোর্বস-এর মত বিশ্বসেরা ম্যাগাজিনে। তাই একথা নিশ্চিত যে দেশের প্রযুক্তিখাত হোক বা অন্য যে কোন ভাবে, এসব স্টার্ট আপ কোম্পানি দেশে নিয়ে আসতে পারে বিশাল পরিবর্তন। আর আমাদের আজকের টপিক ঢাকার এমন কয়েকটি স্টার্ট আপ কোম্পানি নিয়েই।

১. জিয়ন

জিয়ন হল একটি টেলিমেডিসিন সার্ভিস প্রোভাইডার

স্টার্ট আপ কোম্পানি - জিয়ন
জিয়নের ওয়েবসাইট

“জিয়নকাঠি” থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই নাম এসেছে কি না জানা নেই, তবে স্টার্ট আপ কোম্পানি জিয়ন বাংলাদেশের, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য ঠিক তেমনই একটি সেবা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। জিয়ন হল একটি টেলিমেডিসিন সার্ভিস প্রোভাইডার। বাংলাদেশে যারা টেলিমেডিসিন ধারণার প্রবর্তক জিয়ন সেই তালিকার উপরের দিকেই থাকবে। ছোট থাকতে আমরা সবাই পড়ে এসেছি যে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। অধিকাংশ মানুষ আসলেই করে কি না তা নিয়ে তর্ক হতে পারে তবে জিয়নের দেয়া তথ্যমতে তারা বিশ্বজুড়ে শহরের বাইরে বাস করা, চিকিৎসা সুবিধা বঞ্চিত প্রায় ৩০কোটি মানুষকে নিয়ে কাজ করতে চায়। কেস স্টাডি হিসেবে আগ্রহী যে কেউ জিয়নকে নিয়ে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এই ইংরেজি আর্টিকেলটি পড়ে দেখতে পারেন।

নেত্রকোনার মদন উপজেলার এক ৬৫ বছরের বৃদ্ধা যখন হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে হাজার হাজার টাকা খরচ করেও কোন সমাধান পাচ্ছিলেন না, জিয়নের দেয়া সার্ভিসে তিনি সান্নিধ্যে আসেন ঢাকার একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের এবং খুবই অল্প টাকা খরচ করে তিনি পান বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা। জিয়নের সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ হল গ্রামে সাধারণ ফার্মেসির দোকানদার, যারা অনেকক্ষেত্রেই চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির চেয়ে ক্ষতি বেশি করছেন বলেই আধুনিক ডাক্তারদের মত, সেই সব প্রথাগত গ্রাম্য ডাক্তারের বিরুদ্ধে না গিয়ে বরং তাদের সাথে নিয়েই কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া। জিয়নের ভাষ্য হল, অনেক অনেক বছর ধরে, যখন আধুনিক চিকিৎসকেরা গ্রাম এলাকায় পৌঁছাতে পারেন নি, এই গ্রাম্য ডাক্তারেরাই কিন্তু সেখানের মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন। তাই তাদের দূরে ঠেলে না দিয়ে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে তাঁদেরকে কাজে লাগানোই উত্তম। জিয়নের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, জনাব রুবাইয়াৎ খান TedX Dhaka-তে জিয়নকে নিয়ে তার স্বপ্ন এবং সম্ভাবনার কথা বলেছেন যা দেখা যাবে ইউটিউবে।

২. ডেলিগ্রাম

যেখানে অধিকাংশ ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস এখনো মানুষের বিশ্বাস অর্জনে হিমশিম খাচ্ছে, ডেলিগ্রাম সেখানে বেঁছে নিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক বিজনেস মডেল

স্টার্ট আপ কোম্পানি - ডেলিগ্রাম
ডেলিগ্রামের ওয়েবসাইট

ডেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াইজ রহিমের মতে ডেলিগ্রাম হতে চায় বাংলাদেশের আমাজন। আমাজন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ই-কমার্স মার্কেটপ্লেসের একটি। তাদের সাথে ডেলিগ্রামের তুলনা অনেকের কাছে হাস্যকর ঠেকতে পারে। তবে কথায় আছে “মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়!” ২০১৭ এর জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এবং ২০১৮ এর মার্চ থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানো এই স্টার্ট আপ কোম্পানি চায় আমেরিকায় আমাজন এবং চায়নায় আলি এক্সপ্রেস যা করেছে তা বাংলাদেশে করে দেখাতে। যদিও এমন ই-কমার্স কোম্পানি দেশে বেশ কয়েকটি আছে কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন বিজনেস করা অনেক প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ।

যেখানে অধিকাংশ ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস এখনো মানুষের বিশ্বাস অর্জনে হিমশিম খাচ্ছে, ডেলিগ্রাম সেখানে বেঁছে নিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক বিজনেস মডেল। আমাদের দেশের বাস্তবতায় ঘরে ঘরে পণ্য পৌঁছে দেয়া আসলেই অনেক চ্যালেঞ্জিং। তাই তারা ঘরে ঘরে পণ্য পৌছে দেয়ার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে আমাদের দেশী একটি জিনিসের উপর যা অলরেডি প্রতিষ্ঠিত এবং যেখানে প্রতিদিন আছে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা, মুদি দোকান! ডেলিগ্রাম অসংখ্য মুদি দোকানকে তৈরি করছে তাদের এজেন্ট হিসেবে। এখানে লাভ দুপক্ষেরই, ডেলিগ্রাম পাচ্ছে তাদের সার্ভিস মানুষের কাছে পৌঁছাতে আর দোকানদার পাচ্ছেন এমন জিনিসের অর্ডার নিতে যা হয়ত তার দোকানেই নেই। অন্যদিকে কোন দোকানে ডিসপ্লে করা যায় একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক পণ্য, কিন্তু ডেলিগ্রামের মত অনলাইন মার্কেটপ্লেসে এর কোন সীমা নেই। এভাবে একটি বিশেষ সমস্যার সমাধান বিশেষ পদ্ধতিতে করেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকার এই স্টার্ট আপ কোম্পানি । ঢাকার বাইরেও হয়ত খুব শীঘ্রই তারা অপারেশন শুরু করবেন তারা।

৩. বাড়িকই

লোকেশন সার্ভিস এপিআই প্রোভাইডার

স্টার্ট আপ কোম্পানি - বাড়িকই
বাড়িকই-এর ওয়েবসাইট

“রিকশা থেকে গলির মোড়ে নেমে, মসজিদটার পিছে, বড় লাল বিল্ডিংটার পাশে টিনশেড বাড়ি” বাংলাদেশে থাকলে এরকম অভিজ্ঞতা আপনার জন্য একদমই নতুন কিছু না। ঢাকাসহ সারা দেশে প্ল্যান করে ডেভেলপ করা এলাকা খুবই কম। তাই বেশিরভাগ ঠিকানাই গিয়ে ঠেকে এমন অদ্ভুত কিছুতে। আর এই সমস্যা সমাধানের আইডিয়া নিয়েই কাজ করছে স্টার্ট আপ কোম্পানি বাড়িকই। তারা মূলত বাংলাদেশ ভিত্তিক ম্যাপিং কোম্পানি। তাদের প্রধান সেবাই হল লোকেশন সার্ভিস এপিআই প্রোভাইড করা। প্রশ্ন উঠতে পারে, গুগলের মত জায়ান্ট যেখানে দেশে ম্যাপের সার্ভিস দিচ্ছে তাহলে এই স্টার্ট আপ কোম্পানির সুযোগ আসলে কতটুকু? উত্তর লুকিয়ে আছে উপরে উল্লেখ করা ডেলিগ্রামের আইডিয়ার মধ্যেই, যস্মিন দেশে যদাচার! গুগল সারা পৃথিবী নিয়ে কাজ করছে, আর বাড়িকই কাজ করছে স্পেশালি বাংলাদেশ নিয়ে। এছাড়া পারসোনাল ইউজের জন্য গুগল হয়ত কোন সার্ভিস ফি কাটে না কিন্তু বিজনেস টু বিজনেস ব্যবহারের জন্য গুগলের ফি কিন্তু আকাশছোঁয়া। তাই, কোন দেশি স্টার্ট আপ যদি সেই সার্ভিস দিতে পারে তবে কেন নয়? ইতোমধ্যেই সরকারি বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান বাড়িকই-এর সার্ভিস নিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। ২০১৭ তে শুরু হওয়া বাড়ি কই এর লক্ষ্য দেশের প্রধান লোকাল ম্যাপ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিজেদের দাড় করানো।

৪. কুক-আপস

একমাত্র স্টার্ট আপ কোম্পানি যারা আপনাকে সরবরাহ করে হোম-মেড ফুড

স্টার্ট আপ কোম্পানি - কুক আপস
কুক আপস এর ওয়েবসাইট

হাংরি নাকি, ফুড পান্ডার মত ফুড ডেলিভারি চেইন দেশে বেশ কয়েকটি আছে। পাঠাও ফুডস, সহজ ফুডসও বেশ সাড়া ফেলেছে ব্যবহারকারীদের মধ্যে। উবারও সম্প্রতি দেশে চালু করেছে উবার ইটস। তবে কুক-আপস ফুড ডেলিভারি চেইন হলেও একটি বিশেষ কারণে তারা বাকি সবার চাইতে আলাদা। এটিই একমাত্র স্টার্ট আপ কোম্পানি যারা আপনাকে সরবরাহ করবে হোম-মেড ফুড।

কুক আপস হল এমন একটি ফুড ডেলিভারি সিস্টেম যেখানে আপনি যে কোন জায়গা থেকে পাবেন ঘরে বানানো খাবার। অনেকেই হোটেল বা রেস্টুরেন্টে বানানো খাবারের চাইতে ঘরে বানানো খাবার খেতে বেশি স্বাছন্দ্য বোধ করেন। তাদের জন্যই এই ব্যবস্থা। উত্তরা, বনানী, মোহাম্মদপুর, বারিধারাসহ ঢাকার অনেক এলাকাতেই রয়েছে তাদের সার্ভিস। তাদের ওয়েবসাইটে রয়েছে বিভিন্ন এলাকার নানা কুকের তথ্য এবং তাদের করা ভিন্ন ভিন্ন রান্নার আইটেম। চাইলে খুব সহজেই যে কেউ সেখান থেকে অর্ডার করে উপভোগ করতে পারেন ঘরে বানানো স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। বাংলাদেশের হোম মেড খাবারের সবচেয়ে বড় মার্কেটপ্লেস হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে এই স্টার্ট আপ কোম্পানি।

৫. সহজ ডট কম

বাংলাদেশে ই-টিকেটিং সিস্টেমের একপ্রকার পথিকৃত হল সহজ

স্টার্ট আপ কোম্পানি - সহজ
সহজ ডট কম

এই কদিন আগে, কেউ কি ভেবেছিল বাস স্ট্যান্ডে বা কাউন্টারে না গিয়ে, পকেট থেকে নোট বের না করে, নিজের মুঠোফোনে কয়েকটি ক্লিক বা ট্যাপ করেই তিনি কিনে ফেলতে পারবেন বাড়ি যাওয়ার বাসের টিকিট? ডিজিটালাইজেশনের যুগে এটিই এখন বাস্তব এবং বাংলাদেশে এই ই-টিকেটিং সিস্টেমের একপ্রকার পথিকৃত হল সহজ ডট কম। বাংলাদেশে এখন বাস এবং লঞ্চ টিকেটের সবচেয়ে বড় অনলাইন বুকিং প্ল্যাটফর্মও তারা। বাস টিকেট ছাড়াও এখন অনেক ধরনের ইভেন্টের টিকেটও পাওয়া যায় সহজের প্ল্যাটফর্মে। বড় কিছু ইনভেস্টমেন্ট পাওয়ার পর এই স্টার্ট আপ কোম্পানি নতুন ট্রেন্ড রাইড শেয়ারিং সার্ভিসও চালু করেছে।

৬. সেবা এক্সওয়াইজেড

প্রাত্যহিক কাজে লাগে এমন সব ধরণের সার্ভিস পাওয়া যায়  সেবার মোবাইল অ্যাপেই

স্টার্ট আপ কোম্পানি - সেবা
সেবা

বাসার আসবাব বানানো বা ঠিক করা, লন্ড্রি সার্ভিস, এয়ার কন্ডিশন সার্ভিস বা ফিট করা, বাসা বদল, প্যাকিং অথবা কার ওয়াশ, ঘর গৃহস্থালীর যে কোন কাজ এখন করা যায় মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে গিয়েই। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে যে স্টার্ট আপ কোম্পানি তাদের নাম সেবা এক্সওয়াইজেড। সেবা হল দেশের সবচেয়ে বড় ঘর-গৃহস্থালী সার্ভিসের মার্কেটপ্লেস। প্রাত্যহিক কাজে লাগে এমন সব ধরণের সার্ভিস পাওয়া যায় তাদের মোবাইল অ্যাপেই। ২০১৫ সালে অপারেশন শুরু করে মাত্র দুই বছরের মাথায় ৪৭ হাজারেরও বেশি অর্ডার তারা কমপ্লিট করেছে। এক হিসাব মতে সেবা’র বাজার মূল্য এখন ১০মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

ঢাকার বেস্ট কয়েকটি স্টার্ট আপ কোম্পানি নিয়ে এই ছিল আমাদের আজকের লেখা। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে এসব কোম্পানি নিজেদের উন্নতি করে নিচ্ছেন, মাঠে আসছে আরও নতুন নতুন কোম্পানি। আপনার কি মনে হয়, ৫ বছর পর এদের অবস্থান কী হবে? নতুন নতুন প্রতিদ্বন্দীই বা কারা আসবে? জানিয়ে দিন বিপ্রপার্টি ব্লগ এর কমেন্ট সেকশনে।

Write A Comment