Reading Time: 5 minutes

শীতকে বিশেষায়িত করতে এখন আর ‘জবুথবু’, ‘হাড়কাপানো’ বিশেষণ ব্যবহৃত হয় না। শীত মানে এখন হিমকে বরণ করে নেয়ার আনন্দ আয়োজন, প্রকৃতির পালাবদলকে উদযাপনের অনবদ্য উপলক্ষ। এই বরণ আয়োজন পৃথিবীর নানা দেশে করা হয় নানাভাবে। কোথাও শীত উদযাপিত হয় পিঠার উষ্ণতায়, কোথাও শীতের উদযাপনের রীতি তুষার-ভাস্কর্যের শীতলতায়। কিন্তু গতানুগতিকতার বাইরে গিয়েও কোথাও কোথাও উদযাপিত হয় হিম-শীতল এ ঋতুর আগমন। বিচিত্র সেসব উৎসবের কথাই বলছি ‘দেশে দেশে বিচিত্র শীত উৎসব ’ শীর্ষক ব্লগে। 

হার্বিন আন্তর্জাতিক বরফ ও তুষার উৎসব 

হার্বিন আন্তর্জাতিক বরফ ও তুষার উৎসবে প্রতি বছর বরফ দিয়ে ভাস্করের দল গড়ে তোলেন সুবিশাল অট্টালিকা ও স্থাপত্য

চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহর হারবিনে আয়োজিত এ উৎসব পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বরফ ও তুষার উৎসবে। জানুয়ারি মাসে হার্বিনের গড় তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের নিচে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শহরের জিনগুয়েতান ন্যাশনাল ফরেস্ট নামের লেক ঘেরা পার্কের পানি জমে বরফ হয়ে যায়, পড়তে থাকে তুষার শুভ্র বরফ। হার্বিনের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সংহুয়া নদী, নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এখানে প্রায় এক মিটার গভীরতা পর্যন্ত বরফ জমে। যান্ত্রিক করাত দিয়ে সেখান থেকে হাজার হাজার টন বরফ কেটে স্লেজে করে প্রদর্শনীর স্থলে পাঠানো হয়। এরপর জমে ওঠে বরফের শ্বেতশুভ্র উৎসব।  

তুষার ভাস্কর্য তৈরি করার এই বিচিত্র শীত উৎসব-এ প্রতি বছর সমবেত হন প্রায় ১০ হাজার ভাস্কর। কনকনে শীতে বাটালি, কুঠার, করাত দিয়ে তারা কাটতে থাকে বড় বড় বরফের চাই। ১৯৮৫ সালে যখন এ উৎসব শুরু হয়, তখন বরফ কেটে প্রমাণ সাইজের ভাস্কর্য তৈরির কাজে ইলেক্ট্রিক যন্ত্র ব্যবহারের চল ছিলো না। ফলে কাজটি আরো চ্যালেঞ্জিং ছিলো! তবে এখনো ১০-১২ ডিগ্রি হিমাঙ্কে ভারী যন্ত্র দিয়ে বরফ কাটার কাজটি বেশ কঠিন। তবু ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’ নীতি মেনেই প্রতি বছর বরফ দিয়ে ভাস্করের দল গড়ে তোলেন সুবিশাল অট্টালিকা ও স্থাপত্য। তুষার দিয়ে গড়া পৌরাণিক চরিত্র, বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব, প্রাচীন প্রাসাদ, সুবিশাল রেলগাড়ি- কী নেই এ আয়োজনে! ভাস্কর্যগুলো দাঁড়িয়ে গেলে সাজানো হয় বর্ণিল আলো দিয়ে, ব্যবহৃত হয় লেজার। বরফ ভাস্কর্যের এ ফেস্টিভ্যালে থাকে কয়েকটি বিভাগ। যেমন ‘আইস অ্যান্ড স্নো ওয়ার্ল্ড’ এ গেলে দেখা মেলে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ও মজার মজার সব বরফ-ভাস্কর্য। ঝাওলিন পার্কে গেলে চোখ জুড়াবে বরফের বিচিত্র লণ্ঠন দেখে। তুষারের অন্য রূপ চোখে পড়ে সান আইল্যান্ড সিনিক এরিয়ায়। এখানে আছে তুষার জাদুঘরও।  

অনেকে একযোগে বিয়ে করেন বরফ উৎসবে। সাদা পোশাকের ওপর কনেরা পরেন পারকা জ্যাকেট। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য এখানে থাকে সংহুয়া নদীর বরফশীতল জলে সাঁতার প্রতিযোগিতা। এছাড়া উৎসবে আরো থাকে স্কি, আইস স্কেট, আইস সকার খেলা। 

আপ হলি অল ফেস্টিভ্যাল 

আপ হলি ফেস্টিভ্যাল
আপ হলি ফেস্টিভ্যাল উৎসবটি সবচেয়ে বড় করে উদযাপিত হয় লেরউইক দ্বীপে

‘আপ হলি অল’ ফেস্টিভ্যালের স্থানীয় নাম ‘আপ হেলি অ্যা’। শীতকে বিচিত্র উপায়ে উষ্ণতা দিয়ে বরণ করে নেয় স্কটল্যান্ডবাসী, আর সে ভাবনা থেকেই আয়োজিত হয় এই ‘ফায়ার ফেস্টিভ্যাল’। স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন কমিউনিটিতে জানুয়ারি থেকে মার্চের বিভিন্ন সময়ে উদযাপিত হয় বিচিত্র শীত উৎসব। 

নরডিক দেশগুলোতে ‘ইউল’ বলা হয় ক্রিসমাসের সময়কে আর ক্রিসমাসের সময়ের সমাপ্তির পরও উৎসবের আমেজ ধরে রাখার প্রবৃত্তি থেকে আয়োজিত হয় ‘আপ হলি অল’ ফেস্টিভ্যাল। এ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ‘মশাল মিছিল’, যাতে ক্রিসমাস মামারসের মতো কস্টিউম পরে অংশগ্রহণকারীরা। ক্রিসমাস মামারসের কস্টিউম দেখতে খানিকটা হ্যালোউইন কস্টিউমের মত, তবে স্কটিশ লোকগাঁথা ‘মামারস প্লে’ থেকে অনুপ্রাণিত। 

এই উৎসবটি সবচেয়ে বড় করে উদযাপিত হয় লেরউইক দ্বীপে। শেটল্যান্ডের রাজধানী এই দ্বীপশহরে হাজার হাজার মানুষ মশাল মিছিলে যোগ দেয়। জানুয়ারির শেষ মঙ্গলবারে আয়োজিত হয় এই উৎসব। তবে লেরউইকের মশাল মিছিলে নারীদের অংশ নিতে দেয়া হয় না, যে সিদ্ধান্তটি এখনো বেশ বিতর্কিত। 

ফ্রোজেন ডেড গাই ডে

ফ্রোজেন ডেড গাই ডে
ফ্রোজেন ডেড গাই ডে’র মূল উদ্দেশ্য ব্রেডো মোরস্টোয়েল বা গ্র্যান্ডপার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন

ফ্রোজেন ডেড গাই নামের এই বিচিত্র শীত উৎসব আয়োজিত হয় কলোরাডো পর্বতের এক শহর নেদারল্যাণ্ডে। তিন দিন ব্যাপী আয়োজিত অদ্ভূত এই আয়োজনে থাকে ৩০টির বেশি লাইভ ব্যান্ড, হস্তশিল্পের পসরা। এছাড়া যে ব্যাপারগুলো এই উৎসবকে বিচিত্র করে তোলে সেগুলো হলো- কফিন রেসিং, কস্টিউম পরে পোলার প্লাঞ্জিং বা বরফ শীতল পানিতে ডুব দেয়া, ফ্রোজেন টিশার্ট তৈরির কনটেস্ট, টার্কি বোলিং, হিউম্যান ফুসবল ইত্যাদি। 

তবে এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য ব্রেডো মোরস্টোয়েল বা গ্র্যান্ডপা। নেদারল্যান্ডবাসীদের বিশ্বাস তাকে বরফ বানিয়ে টাফ শেড নামের উঁচু ভূমিতে কবর দিয়ে রাখা হয়েছে। 

বু’জো ফেস্টিভ্যাল 

বু’জো ফেস্টিভ্যাল
বু’জো ফেস্টিভ্যাল ‘বিচিত্র শীত উৎসব’ এর তকমা পেয়েছে এতে ব্যবহৃত অদ্ভূতুরে মুখোশগুলোর কল্যাণে

বু’জো ফেস্টিভ্যাল ‘ বিচিত্র শীত উৎসব ’ এর তকমা পেয়েছে এতে ব্যবহৃত অদ্ভূতুরে মুখোশগুলোর কল্যাণে। হাঙ্গেরির মোহাকস শহরের সোকি কমিউনিটির উৎসব এটি, সাধারণত আয়োজিত হয় ‘কার্নিভ্যাল সিজন’ খ্যাত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে। 

বিচিত্র মুখোশ এই উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ ‘বু’জো’ নামের মুখোশ। এতে আরো থাকে লোকগান,প্যারেড ও নাচের আয়োজন। ২০০৯ সালে এই উৎসবটিকে ইউনেস্কো ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি’ তালিকাভুক্ত করে। 

বু’জো ফেস্টিভ্যালকে ঘিরে দুই ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন, অটোম্যান শাসনামলে মোহাক শহরবাসীরা অটোম্যান আর্মির হাত থেকে বাঁচার জন্য জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলো। এক রাতে যখন এই পালিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী জঙ্গলে আগুনের পাশে বসে ছিলো তখন সেখানে আসেন এক সোকাক বৃদ্ধ। তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেন শীঘ্রই মোহাকদের ভালো দিন আসবে। তবে এজন্য এক ঝড়ের রাতে যখন মুখোশ পরা কোনো সৈন্য তাদের কাছে আসবে, তখন মুখোশ পরে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যেতে হবে তাদের। তারা বৃদ্ধের কথামতো প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে, সত্যিই এক রাতে আসে মুখোশ পরিহিত যোদ্ধা। তার নির্দেশনায় মোহাকবাসী অটোম্যানদের আক্রমণ করে। বিচিত্র মুখোশ পরে, বিচিত্র শব্দ করতে করতে এই আক্রমণ পরিচালনা করেন তারা। বলা হয়ে থাকে, একে ‘ডেমন’ বা শয়তানের আক্রমণ ভেবে অটোম্যানরা সূর্যোদয়ের আগেই শহর ছেড়ে চলে যায়। আর এই বিজয়ের উদযাপন করা হয় বু’জো ফেস্টিভ্যালে। অন্য যে গল্পটি প্রচলিত আছে, সেখানে অটোম্যান নয়, বরং শীতকে বিতাড়িত করতে মুখোশ পরেছিলো প্রাচীন মোহাকবাসীরা। 

তবে বর্তমানে ফেব্রুয়ারিতে আয়োজিত এই উৎসব সেখানে শীতের মুখোশ উৎসব হিসেবেই পরিগণিত হয়। মোহাক শহরের প্রথা, এই সময়ে ‘গেস্ট বুজো টিমস’ বা ‘অতিথি বুজোর দল’ ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া ও পোল্যান্ডের মানুষকে আতিথেয়তা দেয়া। 

তাখিনি হট স্প্রিংস হেয়ার ফ্রিজিং ফেস্টিভ্যাল 

তাখিনি হট স্প্রিংস হেয়ার ফ্রিজিং ফেস্টিভ্যাল
তাখিনি হট স্প্রিংস হেয়ার ফ্রিজিং ফেস্টিভ্যালের মূল আকর্ষণ  চুল বরফ করার প্রতিযোগিতাটি

কানাডায় আয়োজিত হয় এই বার্ষিক শীত উৎসব। মূলত এটি একটি প্রতিযোগিতা, যেখানে প্রতিযোগীরা চুল বরফ করার লড়াই করে। কানাডার ইউকন অঞ্চলে -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। 

এই বিচিত্র শীত উৎসব এর মূল আকর্ষণ স্বভাবতই চুল বরফ করার প্রতিযোগিতাটি। প্রথম ধাপে -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে ডুব দিতে হয়, তারপর ভেজা চুল-দাড়ি-ভ্রু নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। শীতল বাতাসে এক পর্যায়ে চুল, দাড়ি, ভ্রুতে বরফ জমতে শুরু করে। পুরোপুরি বরফ সাদা হয়ে যাওয়ার পর ছবি তুলে রাখা হয়। উৎসবের শেষে ঘোষণা করা হয় বিজয়ীদের নাম। অনেকে দর্শনার্থী হিসেবেও হেয়ার ফ্রিজিং ফেস্টিভ্যাল দেখতে আসেন। এখানে থাকে গান ও খাবারের আয়োজন। 

শীতকে কেমন বিচিত্র ভঙ্গিতে আমন্ত্রণ জানায় ও উদযাপন করে বিশ্ববাসী, জানা গেলো তার কিছু অংশ। শীতের আরো কোনো বিচিত্র উৎসবের কথা যদি আপনার জানা থাকে, তবে লিখতে পারেন কমেন্টস বক্সে। 

Write A Comment