আমাদের বাড়ি নির্মাণ সংক্রান্ত আগের লেখাটিকে সবাই সাদরে গ্রহণ করেছেন। তবে সেটি পড়ে অনেকেই জানতে চেয়েছেন আরও বিস্তারিত, বিশেষ করে বাড়ির ফাউন্ডেশন নির্মাণে খরচের বিস্তারিত।
বাড়ির ভিত বা ফাউন্ডেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ভবনের দীর্ঘস্থায়ীত্ব অনেকাংশেই নির্ভর করে ভিতের উপর। আর বর্তমান সময়ে অনেক বেশি হাইরাইজড বা সুউচ্চ ভবন নির্মিত হচ্ছে। ফলে ফাউন্ডেশনের গুরুত্ব বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে। তবে, বাড়ির ভিত নির্মাণে বেশ কিছু জটিল জিনিসের প্রয়োজন। আর সব হিসাব মিলিয়ে বাড়ির ফাউন্ডেশন নিয়ে কোন পূর্ব অনুমান কিংবা খরচের হিসাব করাটা সবসময়েই একটু কঠিন। তার উপর, ফাউন্ডেশনের রয়েছে বিভিন্ন ধরণ। তাই চলুন, খরচ নিয়ে কথা বলার পূর্বে আমরা জেনে নেই বাড়ির ফাউন্ডেশনের রকমফের সমন্ধে।
বাড়ির ফাউন্ডেশন কত প্রকার
আপনার বাড়ির জন্য কী ধরেনর ফাউন্ডেশন প্রয়োজন তা পুরোপুরি নির্ভর করছে দুটি বিষয়ের উপর, মাটির কোয়ালিটি অর্থ্যাৎ বাড়ি নির্মাণের জন্য মাটি কতটা উপযোগী এবং ভবনের উচ্চতা। সাধারণত সব ধরণের ফাউন্ডেশনকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, অগভীর ফাউন্ডেশন যা মাত্র ১ মিটার হতে পারে, এবং গভীর ফাউন্ডেশন যার গভীরতা ২০ থেকে ৬৫ মিটার পর্যন্ত হওয়া সম্ভব।
ম্যাট ফাউন্ডেশন
খরচের দিক থেকে ম্যাট ফাউন্ডেশন হল সবচেয়ে ব্যয়বহুল। কারণ বিভিন্ন ধরণের উপাদান অনেক বেশি পরিমাণে ব্যবহার করতে হয় এক্ষেত্রে। “ম্যাট” শব্দটি শুনলে আমাদের মাথা যে ফ্লোড় ম্যাটের কথা মনে হয়, ম্যাট ফাউন্ডেশনের আইডিয়াও অনেকটা এরকমই। এই ফাউন্ডেশনে পুরু কংক্রিটের একটি স্ল্যাব ভবনের ভিত্তি হিসাবে কাজ ক্রএ। এই স্ল্যাব তৈরিতে ব্যবহৃত হয় স্টীল, ওয়াল এবং সাপোর্টিং কলাম। যেহেতু পাইলিং বা পিলারের পরিবর্তে এতে কংক্রিটের র্যাফট বা স্ল্যাব ব্যবহার করা হয়, সেজন্য অপেক্ষাকৃত নরম, বাড়ি নির্মাণের জন্য কম উপযোগী ভবনে ফাউন্ডেশন দিতে এটি ব্যবহৃত হয়। এছাড়া হাইরাইজড বিল্ডিঙের নিচে আন্ডারগ্রাউণ্ড গ্যারেজ তৈরির ক্ষেত্রেও এটি সমান উপযোগী।
ম্যাট ফাউন্ডেশনের মূল ভিত্তি হল রি-ইনফোর্সড কংক্রিট সিমেন্ট বা আর.সি.সি স্ল্যাব। ১২৫ মিমি পুরুত্ব বিশিষ্ট ২০০০ বর্গফুট বা ১৮৬ বর্গ মিটার আয়তনের একটি আর.সি.সি স্ল্যাব তৈরির জন্য প্রয়োজন ২৩.২ ঘনমিটার (মি৩) কংক্রিট। যদি আমরা বহুল ব্যবহৃত এম২০ গ্রেড মিক্স ডিজাইনকে (১ঃ১.৫ঃ৩) আমলে নেই তাহলে সম্ভাব্য উপাদান দরকার পড়বে
১. সিমেন্টঃ ১৮৫-১৮৬ ব্যাগ (৪০০ কেজি/মি৩)
২. বালুঃ ১৩,৯২০ কেজি (৬০০ কেজি/মি৩)
৩. খোয়া বা সুড়কিঃ ২৭,৮৪০ কেজি (১,২০০ কেজি/মি৩)
৪. স্টিলঃ ১,৭৪০ কেজি (৭৫ কেজি কেজি/মি৩)
পাইল ফাউন্ডেশন
আগেই বলা হয়েছে এখনকার যুগ আকাশছোঁয়া সুউচ্চ ভবনের যুগ। বর্তমান যুগে এমন উঁচু ভবনের চাহিদা অত্যধিক। তবে, উপরের আকাশের দিকে যাবার অর্থই হল নিচের দিকেও নজর দেয়া। এমন উঁচু ভবনের জন্য ফাউন্ডেশনও হওয়া চাই তেমন মজবুত। তাই গভীর ভিতের প্রয়োজন। আর এজন্য পাইল ফাউন্ডেশনের জনপ্রিয়তা অনেক বেহসি। পাইলিং শব্দটি আমরা অনেকেই শুনেই, সেটি এই পাইল ফাউন্ডেশন থেকেই এসেছে। তবে খরচের দিক থেকে এটি ম্যাট ফাউন্ডেশনের থেকে কিছুটা কম খরুচে। বড় বড় কংক্রিট বা স্টিল নির্মিত কলাম কিংবা সিলিন্ডারকে মাটির অভ্যন্তরে গেঁথে দেয়া হয়, যার উপরেই থাকে উপরের কাঠামোর ভর। এমন কলামগুলো সম্পূর্ণ স্থাপনার ভরকে উপরের নরম মাটিকে এড়িয়ে নিচে শক্ত মাটির উপরে নিয়ে ফেলে, ফলে ভবন হয় অধিকতর মজবুত। তাই ভবন যত উঁচু হয়, তত গভীর ফাউন্ডেশনের প্রয়োজন পরে এবং খরচও বেড়ে যায়।
যে কোন সাধারণ মানুষের জন্যই এমন ফাউন্ডেশনে ঠিক কতটি পাইল দরকার তা নির্ধারণ করা কঠিন বিষয়। এজন্য আগে জানা দরকার মাটির কোয়ালিটি, ভবনটি কী ধরণের তা জানা, এর উচ্চতা, ভর এবং আরও আনুষাঙ্গিক জিনিস। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় পাইলগুলোর মধ্যবর্তী দুরত্ব ১১ থেকে ১৫ মিটারের মত। এর চেয়েও জটিল হল প্রতিটি পাইলে কী পরিমাণ কংক্রিট লাগবে না নির্ধারণ করা। এজন্য আপনার জানতে হবে সেই পাইল, কলাম বা বিমের উচ্চতা কত হবে এবং সম্পূর্ণ পাইল বা বিমের ব্যাসার্ধ কত। এরপর ছোট বেলায় শেখা সিলিন্ডারের আয়তন বের করার সূত্র তথা πr২h (পাই * আর স্কয়ার* এইচ) ব্যবহার করতে হবে যেখানে “r” হল ব্যাসার্ধ এবং “h” উচ্চতা।
উদাহরণস্বরূপ ২১ মিটারের একটি পাইল বা কলাম যার ব্যাস ০.৪ মিটার, বানানোর জন্য ২৬.৩ ঘনমিটার কংক্রিটের প্রয়োজন। আর এমন একটি কলামের জন্য দরকার পড়বে (সম্ভাব্য) –
১. সিমেন্টঃ ১৯১–১৯২ ব্যাগ (৩৬৪.৫ কেজি/মি৩)
২. বালুঃ ১৪,৩৭৯ কেজি (৫৪৬.৭৫ কেজি/মি৩)
৩. খোয়া বা সুড়কিঃ ২৮.৭৫৯ কেজি (১,০৯৩.৫ কেজি/মি৩)
৪. স্টিলঃ ৪,১৮০ কেজি (১৬০ কেজি/মি৩)
আইসোলেটেড স্প্রেড ফুটিং ফাউন্ডেশন
জনপ্রিয় আরেকটি অগভীর ফাউন্ডেশন হল এই আইসোলেটেড স্প্রেড ফুটিং ফাউন্ডেশন যা সংক্ষেপে ফুটিং ফাউন্ডেশন হিসাবেই বেশি পরিচিত। নির্মাণে কম খরচ এবং পর্যাপ্ত ভর বহনের সক্ষমতাই এই ফাউন্ডেশনকে করে তুলেছে জনপ্রিয়। এতে প্রতিটি বিমের নিচে থাকে আয়তাকৃতির ফুটিং বা তলদেশ। এরফলে কলাম বা বিমগুলি সরাসরি মাটিতে ভর দিয়ে থাকে। তবে এমন ফাউন্ডেশন শুধু মাত্র ভবন নির্মাণের জন্য সু-উপযোগী মাটিতেই দেয়ায় সম্ভব কেননা ভর মূলত উপরের দিকের মাটিতেই পরে। বিম বা কলামের আকৃতি নির্ধারিত হয়ে থাকে মাটি কতটা ভর নিতে পারে তাঁর সাথে মোট ভরের একটি অনুপাত করে। যদি ভর হয় ৩০০ কিলোটন আর মাটি প্রতি বর্গমিটারে নিতে পারে ২৫০ কিলোটন চাপ তাহলে ফুটিং এর আয়তন হতে হবে ৪বর্গমিটার। এজন্য ফুটিং বা তলদেশে কংক্রিট দরকার ০.১৪ ঘনমিটার এবং একটি ৯X১২ আকারের প্রমাণ সাইজের বিমের জন্য কংক্রিট দরকার ০.০১৫ ঘনমিটার। এজন্য যে পরিমাণ কাচামাল দরকার তা হল –
ফুটিং বা তলার জন্যঃ
১. সিমেন্টঃ ৫৬ কেজি
২. বালুঃ ৮৪ কেজি
৩. খোয়া বা সুড়কিঃ ১৬৮ কেজি
৪. স্টিলঃ ১০.৫ কেজি
বিমের জন্যঃ
১. সিমেন্টঃ ৬০ কেজি
২. বালুঃ ৯০ কেজি
৩. খোয়া বা সুড়কিঃ ১৮০ কেজি
৪. স্টিলঃ ১৩.৫-২৩ কেজি
এখান বিভিন্ন ধরণের ফাউন্ডেশন এবং তাঁর জন্য কী পরিমাণ কাচামাল দরকার তা যেহেতু আমরা জানি, তাই বর্তমান বাজারদরের প্রেক্ষিতে তার জন্য কেমন খরচ হতে পারে চলুন তা দেখে নেয়া যাক-
- সিমেন্টঃ ৪৬০-৪৭০ টাকা প্রতি ব্যাগ (৫০ কেজি)
- স্টিলঃ ৭০,০০০-৭২,০০০ টাকা প্রতি টন
- বালু এবং খোয়া বা সুড়কিঃ ১০,০০০-১২,০০০ প্রতি ট্রাক
বাংলাদেশে যে কোন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাড়ির ফাউন্ডেশন নির্মাণ করতেই সিংহভাগ খরচ হয়ে যায়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কাচামালের ক্রমবর্ধমান মূল্যহার। সে যাই হোক, আমরা আশা করছি, আমাদের এই লেখাটি পড়ে আপনি বাড়ির ফাউন্ডেশন দিতে কেমন খরচ হতে পারে তা নিয়ে সামান্য হলেও ধারণা পেয়েছেন। বাড়ি নির্মাণ নিয়ে পরবর্তী লেখার জন্য আমাদের সাথেই থাকুন।
2 Comments
Good lecture.thanks.
Thanks for your helpful article.