Reading Time: 5 minutes

বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনন্য স্বাক্ষর এর পুরোনো মন্দিরগুলো। কোনো মন্দিরের চত্ত্বরে যুগ-যুগ আগে ধ্যানমগ্ন ছিলেন প্রাচীন ঋষি-মুনির দল, কোনো মন্দির হয়তো প্রাচীন জনপদের ঐতিহ্য ও জীবনযাত্রার ছাপ ধারণ করছে। সারা বিশ্বেই অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী, ঐতিহ্যগত তাৎপর্য, ইতিহাসের প্রেক্ষিতে গুরুত্বের সূত্র ধরে পুরোনো মন্দিরগুলো হয়ে উঠেছে অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। আমাদের দেশের মন্দিরগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। স্থাপত্যের বৈচিত্র্যে, ইতিহাসের স্বাতন্ত্রের আলোকে বাংলাদেশের পুরোনো মন্দির গুলো অনন্য নিদর্শন। ‘ ফিরে দেখি ইতিকথা’ সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে থাকছে এ মন্দির গুলোর গল্প!   

ঢাকেশ্বরী মন্দির

Dhakeshwari Mandir

ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির হল ঢাকেশ্বরী মন্দির। বলা হয়ে থাকে, এর নাম দেয়া হয়েছে “ঢাকার ঈশ্বরী” অর্থাৎ ঢাকা শহরের রক্ষাকর্ত্রী দেবী হতে। রাজা বল্লল সেন ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের কোন এক সময় এটি নির্মাণ করেছিলেন। কালক্রমে এটি ঢাকার জাতীয় মন্দির হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার পূর্ব পাশে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের দক্ষিণ পশ্চিমে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের অবস্থান। লালবাগের অরফানেজ রোডই এর ঠিকানা। বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি তত্ত্ববধায়ন ও নিয়ন্ত্রণ করে। 

বাংলাদেশে শারদোৎসবের মূল কেন্দ্র হল রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঢাকেশ্বরী মন্দির। শারদোৎসবের চার দিন দর্শনার্থীদের ভিড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে এই মন্দির প্রাঙ্গন। 

ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি কয়েকটি মন্দির ও সৌধ নিয়ে তৈরি। এই মন্দিরকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করা যায়।ভেতরের দিক হলো অন্তর্বাটি, বাইরের দিক বহির্বাটি।  পূর্বদিকে মন্দিরের অন্তর্বাটি ও পশ্চিমদিকে এর বহির্বাটি। অন্তর্বাটিতে আছে প্রধান মন্দির এবং নাটমন্দির। বহির্বাটিতে পাবেন কয়েকটি মন্দির, একটি পান্থশালা (অতিথিশালা) ও বেশ কয়েকটি ঘর। মন্দিরের পশ্চিম দিকে রয়েছে একটি প্রাচীন দিঘি ও দক্ষিণ-পূর্ব কোণে পাবেন একটি প্রাচীন বটগাছ। ঐ দিঘি সংলগ্ন জমিতেকয়েকটি সমাধিও রয়েছে। 

আবার দিঘির উত্তর-পূর্ব কোণে একই সারিতে একই রকম দেখতে চারটি ছোট মন্দির রয়েছে। সবার মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াসে স্থাপিত হয়েছে একটি লাইব্রেরিও। মন্দিরের প্রশাসনিক ভবনের ২য় তলায় এর অবস্থান। তবে এই পাঠাগার দর্শনার্থী বা অতিথীদের জন্য উন্মুক্ত নয়। 

আগেই বলেছি, বর্তমানে এখানে প্রতি বছর ধুমধামের সঙ্গে সনাতন ধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই মন্দিরে প্রতিদিনই ঈশ্বরের প্রার্থনাও করা হয়। প্রতি শুক্রবার মা সন্তোষী, শনিবার শনিদেবের পূজা, রোববার কীর্তন হরি সেবা, সোমবার শিব পূজা, মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার দেবীদূর্গার পূজা আয়োজিত হয়। পাশাপাশি সাপ্তাহিক পূজাও হয়ে থাকে। আর প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় আরতি তো হয়ই। আক্ষরিক অর্থেই যেন ১২ মাসে ১৩ পূজা! 

রমনা কালী মন্দির 

Ramna Kali Mandir

ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরসমূহের মধ্যে অন্যতম রমনা কালী মন্দির। এর আরেক নাম রমনা কালীবাড়ি। এটি প্রায় এক হাজার বছরেরও পুরাতন বলে জনশ্রুতি আছে। বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বহির্ভাগে এটি অবস্থিত। 

ইতিহাস বলে, প্রায় ৫০০ বছর আগে বদরীনাথের যোশীমঠ থেকে গোপালগিরি নামে একজন সন্ন্যাসী প্রথমে ঢাকায় এসে সাধন-ভজনের জন্য উপযুক্ত একটি আখড়া গড়ে তোলেন। সেখানেই আরও ২০০ বছর পরে মূল রমনা কালীমন্দিরটি নির্মাণ করেন সাধু হরিচরণ গিরি। তবে পরবর্তী সময়ে এই মন্দিরের প্রধান সংস্কারকার্য ভাওয়ালের ভক্তিমতী ও দানশীলা রানি বিলাসমণি দেবীর দায়িত্বে করা হয়। 

১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চ রমনা কালীমন্দিরে বীভৎস হত্যাযজ্ঞ চালায় পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই তীর্থভূমি পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। সেই দুইদিন রমনা কালীমন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরি সহ সেখানে উপস্থিত প্রায় ১০০ জন নারী ও পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাক সেনারা। এই হত্যাকাণ্ডের সময় রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম দাউ দাউ করে জ্বলেছিল। রমনা কালীমন্দিরের চূড়া ছিল ১২০ ফুট, যা বহুদূর থেকে দেখা যেত। সেটিও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় বর্বর সেনারা। ২০০৬ সালে রমনা কালীমন্দির আবার নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়।

রমনা কালী মন্দিরে বর্তমানে কালী মন্দির ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি প্রতিমার মন্দির  রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো, দুর্গা মন্দির, লোকনাথ মন্দির, রাধা গোবিন্দ মন্দির, মা আনন্দময়ীর মন্দির।তবে রমনা কালী মন্দির এর মূল পূজা হলো কালী পূজা।। এখানে দুর্গাপুজোও খুব বড় করে হয়। তাছাড়া এখানে সরস্বতী পুজা, বাৎসরিক অনুষ্ঠান সহ নানা ধরনের ধর্মীয় উৎসব এখানে হয়ে থাকে । 

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু ভক্ত আসেন মন্দিরে। ভারত থেকেও ভক্তরা আসেন। উৎসবমুখর হয়ে ওঠে বাংলাদেশের পুরোনো মন্দির চত্ত্বর।

পুঠিয়া মন্দির চত্ত্বর 

Puthia rajbari temple Rajshahi

বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের পুঠিয়া উপজেলায় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরনো হিন্দু মন্দির নিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের পুরোনো মন্দির, পুঠিয়া মন্দির চত্বর। রাজশাহী শহরের ২৩ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত এটি। ধারণা করা হয়, এখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ঐতিহাসিক মন্দির রয়েছে। পুঠিয়া রাজ পরিবারের হিন্দু জমিদার রাজাদের উদ্যোগে মন্দিরগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

মন্দিরগুলোর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য টেরাকোটার কাজ এবং এগুলোর স্থাপত্য জোড় বাংলা স্থাপত্য রীতির সাথে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে এতে অন্যান্য স্থাপত্য রীতির ছাপও রয়েছে। অনেকের মতে, পুঠিয়ার রাজবাড়িটি ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্য রীতি অনুসারে নির্মিত। অর্থাৎ গতানুগতিক হিন্দু স্থাপত্য রীতির সাথে রেনেসাঁস যুগের ইউরোপীয় স্থাপত্যের সংমিশ্রণে এটি গড়ে তোলা হয়েছে। পুঠিয়ার মন্দিরগুলোর কেন্দ্রস্থলে বিশালাকার লেক বা জলাধার রয়েছে। মন্দিরগুলোর মাঝামাঝি অংশে একটি সবুজ চত্বরও রয়েছে। ফলে এ মন্দিরের মনোরম স্থাপত্য ও ইতিহাস একে করে তুলেছে তাৎপর্যবহ। 

কান্তজীর মন্দির 

Kantajew Temple, Dinajpur

কান্তজির মন্দিরের অনেক নাম। কেউ বলেন কান্তজী মন্দির, কারো কাছে তা কান্তনগর মন্দির। বাংলাদেশের দিনাজপুরে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির এটি। মন্দিরটি হিন্দু ধর্মের কান্ত বা কৃষ্ণের মন্দির হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ রাধা-কৃষ্ণের ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী পূজা হয় এখানে। ধারণা করা হয়, মহারাজা সুমিত ধর শান্ত এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। 

দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার (১২ মাইল) উত্তরে ঢেঁপা নদীর তীরবর্তী গ্রাম কান্তনগরে অবস্থিত এই প্রাচীন মন্দির। মন্দিরের উত্তর দিকে রয়েছে ভিত্তিবেদীর শিলালিপি। সেখান থেকে জানা যায়, তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তার শেষ বয়সে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পরে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। শুরুতে মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিলো ৭০ ফুট। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটি ভূমিকম্পের কবলে পড়লে এর চূড়াগুলো ভেঙে যায়। মহারাজা গিরিজানাথ মন্দিরের ব্যাপক সংস্কার করলেও মন্দিরের চূড়াগুলো আর সংস্কার করা হয়নি।

মন্দিরের বাইরের দেয়াল জুড়ে পোড়ামাটির ফলকে লেখা রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী। পুরো মন্দিরে প্রায় ১৫,০০০-এর মতো টেরাকোটা টালি পাওয়া যায়। উপরের দিকে তিন ধাপে উঠে গেছে মন্দিরটি। মন্দির প্রাঙ্গন আয়তাকার হলেও, পাথরের ভিত্তির উপরে দাঁড়ানো ৫০ ফুট উচ্চতার মন্দিরটি বর্গাকার। নিচতলার সব প্রবেশপথে বহু খাঁজযুক্ত খিলান বা জানালা রয়েছে। দুটো ইটের স্তম্ভ দিয়ে সেগুলো আলাদা করা হয়েছে। স্তম্ভ দুটো খুবই সুন্দর এবং সমৃদ্ধ অলংকরণযুক্ত। মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচতলায় প ২১টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২৭টি দরজা-জানালা রয়েছে, তবে তৃতীয় তলায় এর সংখ্যা মাত্র ৩। 

বাংলাদেশের পুরোনো মন্দির নিয়ে লিখতে লিখতে যেন নিজেই ঘুরে এলাম ইতিহাস-ঐতিহ্যের এই পীঠস্থানগুলো থেকে। প্রাচীন ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহী যারা, তারা চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন এ মন্দির গুলো। তবে ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ এসব স্থানে আচরণবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সতর্ক থাকাই কাম্য। বাংলাদেশের পুরোনো মন্দির গুলোর ব্যাপারে আপনিও যদি কোনো তথ্য যোগ করতে চান বা এ নিয়ে যদি আপনার কোনো মতামত থাকে, লিখতে পারেন আমাদের কমেন্টস বক্সে। সেইসাথে জানাতে ভুলবেন না কেমন লাগছে আমাদের ‘ফিরে দেখি ইতিকথা’ সিরিজের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব। 

1 Comment

  1. Anjan Dhar

    বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য হিন্দু মন্দির সম্বন্ধে আরও জানতে চাই

Write A Comment