Reading Time: 5 minutes

পছন্দসই লোকেশনে ফ্ল্যাট দেখতে শুরু করেছেন? ফ্ল্যাট ঘুরে দেখার এ সময়টি আপনার ভবিষ্যত আবাসের নিরাপদ ও আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে ভীষণ জরুরি। বাড়ির কোন অংশে মেরামত প্রয়োজন বা কোন জায়গায় একটু বাড়তি খরচ করতে হবে- এগুলো কিন্তু কখনোই শুধু ছবি দেখে বা বাড়ি বিক্রেতার কথা শুনে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। অনেক সময় নিজে উপস্থিত থেকে ফ্ল্যাট দেখার ফলে এমন কিছু বিষয়ও বুঝতে পারা যায় যা আপনাকে বিক্রেতার সাথে নেগোসিয়েশনে সহায়তা করবে। যেমন- বিক্রেতা হয়তো বলছেন ফ্ল্যাটে পর্যাপ্ত আলোবাতাস পাওয়া যায়। কিন্তু আসলে পূর্ব দিকের বারান্দার সামনে রয়েছে এক বিশাল বহুতল ভবন; তাই সেদিকের ঘরগুলোতে দিনরাত আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এর ওপর ভিত্তি করে আপনি বিক্রেতার সাথে বাড়ির দাম নিয়ে খানিকটা আলোচনাও/দর কষাকষিও করে নিতে পারেন। এছাড়া বাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন তা জানতেও হোম ইন্সপেকশন এর কোনো বিকল্প নেই।

আপনার বাছাই করা ফ্ল্যাটটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা পেতে হলে তাই হোম ইন্সপেকশন এর সময় কয়েকটি দিক অবশ্যই খেয়াল করতে হবে। সেগুলো হলোঃ

বৈদ্যুতিক সংযোগ

বৈদ্যুতিক সংযোগ বক্স
বৈদ্যুতিক সংযোগ যাচাই করুন

আর্থিংঃ

প্রথমেই জেনে নিন, পাওয়ার আউটলেটে যথাযথভাবে আর্থিং বা গ্রাউন্ডিং করা আছে কিনা। আর্থিং  হলো এমন এক প্রক্রিয়া যা বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য বিকল্প পথ তৈরি করে। ওভারলোড, ভোল্টেজের ওঠানামা বা বৈদ্যুতিক সংযোগের ত্রুটির কারণে ডিভাইস পুড়ে যাওয়া, বাড়িতে আগুন লেগে যাওয়ার মতো বড় দুর্ঘটনাগুলো এড়াতে হলে আর্থিং থাকা আবশ্যক।

সার্কিট ব্রেকারঃ

অনেক সময় পুরোনো বাড়িগুলোতে সার্কিট ব্রেকার বা ফিউজ বক্সের কার্যক্ষমতা কম থাকে। ফলে আধুনিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নানা বৈদ্যুতিক ডিভাইস যেমন ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ওভেন, ব্লেন্ডার ইত্যাদি ব্যবহার করতে চাইলে স্বল্প ক্ষমতাসম্পন্ন এই সার্কিট ব্রেকারগুলো যথেষ্ট হয়না। সেক্ষেত্রে ইলেকট্রিক প্যানেলের কার্যক্ষমতা কীভাবে বাড়ানো যায় তা জানতে ভুলবেন না।

পাওয়ার আউটলেটঃ

সুইচবোর্ড এবং পাওয়ার আউটলেটগুলো ঠিক ভাবে কাজ করছে কিনা তাও জেনে নেয়া উচিত। কেননা এগুলোতে ত্রুটি থাকলে চার্জ দেয়ার সময় মোবাইল, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া বাড়ির কোথাও অরক্ষিত অবস্থায় বৈদ্যুতিক তার বেরিয়ে আছে কিনা সেটিও দেখে নেয়া প্রয়োজন। বিশেষত রান্নাঘর ও ওয়াশরুমে যেহেতু পানির কল ও পাওয়ার আউটলেট দুটোই থাকে, তাই এ জায়গাগুলোর পাওয়ার আউটলেট কতটা নিরাপদ সেটি যাচাই করে নেয়া সবচেয়ে বেশি জরুরি।

ঘরের ছাদ, দেয়াল ও মেঝে

ছাদ
ঘরের ছাদ, দেয়াল ও মেঝে খেয়াল করুন

আর্দ্রতাঃ

আমাদের দেশে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি। এছাড়া বছরের বেশ অনেকটা সময় ধরেই নিয়মিত বৃষ্টি হয়। আবহাওয়ার এ বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে অনেক সময় ঘরের ছাদ, দেয়াল ও মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায়; যদিও এই স্যাঁতস্যাঁতে মেঝে দূর করারও রয়েছে অনেক উপায়। শুধু তাই নয়, এ থেকে ঘরে মোল্ড বা চিতি নামক ছত্রাকের সংক্রমণও ঘটে, যা ঘরের বাতাসকে দূষিত করে তোলে ও অ্যালার্জির সংক্রমণ ঘটায়। বাড়ি দেখার সময় এ বিষয়গুলো বুঝতে হলে খেয়াল করুন, ছাদ, দেয়াল বা মেঝের কোনো অংশে রংয়ের তারতম্য আছে কিনা বা প্লাস্টার উঠে আসছে কিনা। এছাড়া কার্ডবোর্ডের পেছনে, দেয়ালে লাগানো ফার্নিচারের পেছনে ও ইলেকট্রিক গিজারের আশেপাশের দেয়ালে ড্যাম বা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব থেকেও এ বিষয়গুলো বোঝা যায় ।  অনেক সময় পানির পাইপের লিকেজ থেকে ঘরের দেয়াল বা মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায়। এক্ষেত্রে পাইপগুলোতে কোনো লিকেজ বা ছিদ্র আছে কিনা সেটিও দেখতে ভুলবেন না। হোম ইন্সপেকশন এর সময়ে ঘরের ছাদ, দেয়াল ও মেঝে ভালোভাবে যাচাই করতে হবে। 

গঠনঃ

ছাদ, দেয়াল বা মেঝের গঠনগত ত্রুটির বিষয়গুলোও দেখে নেয়া উচিত। কেননা বাড়ির ছাদে লিকেজ বা মেঝের ভাঙ্গা টাইলস ঘরে পানি আসার মতো নানা অসুবিধার সৃষ্টি করে।  

জানালা দরজা

দরজা
জানালা দরজা খুলে ভাল মত দেখুন

ফিটিংসঃ

ফ্ল্যাটের সবগুলো দরজা জানালা একবার খুলে দেখে নেয়া উচিত। এর ফলে দরজা জানালার ফিটিংস বা কাঁচে কোনো গঠনগত ত্রুটি থাকলে সেটি খেয়াল করে নেয়া যায়। জানালা দরজা দেখে নেবার সময় ঘরে যথেষ্ট আলোবাতাস আসে কিনা সেটিও যাচাই করে নিন।

লকঃ

এছাড়া একটি নিরাপদ বাড়ি বেছে নিতে হলে দরজা-জানালার লকগুলোও চেক করা খুব দরকারি। প্রয়োজনে আপনার পছন্দমতো লক সিস্টেম লাগিয়ে নেয়া যাবে; তবে এ নিয়ে শুরুতেই আলোচনা করে ফেলা উচিত।

পাইপ ও প্লাম্বিং

পানির নল
পাইপ-প্লাম্বিংয়ের মতো জরুরি বিষয়গুলো আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়

পানির পাইপ ও সিংকঃ

হোম ইন্সপেকশন এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, এই পাইপ ও প্লাম্বিং দেখা। এগুলো ফিটিং করাতে যেমন টাকা খরচ হয় তেমনি এগুলো মেরামত করাতেও। সুতরাং, অবশ্যই খেয়াল করুন।  আমরা অনেক সময় রান্নাঘর বা ওয়াশরুমের টাইলস, ফিটিংস বা কেবিনেট চেক করতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে পাইপ-প্লাম্বিংয়ের মতো জরুরি বিষয়গুলো আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। অথচ পাইপে ছিদ্র বা পানির লাইনে ক্লগিং ভীষণ দুর্ভোগের কারণ হতে পারে। তাই প্রতিটি শাওয়ার, কল, বেসিন ও সিংক পানি ছেড়ে দেখে নেয়া জরুরি।

সেপটিক ট্যাংক ও স্যুয়ারেজ লাইনঃ

সেপটিক ট্যাংকটি ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা তা বিক্রেতার কাছ থেকে অবশ্যই জেনে নিতে ভুলবেন না। এছাড়া শহরের স্যুয়ারেজ লাইনের সাথে বাড়িটির ওয়েস্ট ওয়াটার সিস্টেম বা ড্রেন যথার্থ ভাবে সংযুক্ত আছে কিনা সেটিও খেয়াল করুন। প্রয়োজনে প্লাম্বিং মিস্ত্রি দিয়ে এগুলো চেক করে নেয়া উচিত। কেননা প্রায়ই এসব লাইনে আবর্জনা জমে সিংক বা বেসিন ক্লগড হয়ে যায়। ফলে বাসিন্দাদের ভীষণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

ইলেকট্রিক গিজারঃ

বাড়িতে ইলেকট্রিক গিজারের ব্যবস্থা আছে কিনা না তা জেনে নিন। যদি থাকে, তবে তা যাচাই করে নিন। বিশেষত এর আশেপাশের দেয়াল, মেঝে বা কেবিনেটের অবস্থা দেখে নিতে ভুলবেন না কারণ শহরের অনেক বাড়িতেই গিজারের আশেপাশের দেয়ালে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব লক্ষণীয়।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা

 সিসিটিভি ক্যামেরা
সিসিটিভি ক্যামেরা আছে কিনা

সিসিটিভি ক্যামেরা ও দারোয়ানঃ

দরজা জানালার লকগুলো চেক করার পাশাপাশি যে সকল উপায়ে বাসার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে তা জেনে নিতে হবে এক্ষেত্রে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে কিনা, দারোয়ান বা বিল্ডিং সুপারভাইজার কতটুকু সতর্ক থাকবে সেসব শুরুতেই আলোচনা করে নেয়া ভালো।

অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থাঃ

আমরা অনেকেই আগুন লাগলে কী করতে হবে সেসব সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানিনা। অথচ ফায়ার অ্যালার্ম, ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র, ফায়ার এক্সিট থাকা আমাদের নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই জরুরি। মনে রাখতে হবে, দুর্ঘটনা যেকোনো সময়ই ঘটতে পারে। হোম ইন্সপেকশন এ তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই।

নির্মাণ সামগ্রী

রড সিমেন্ট
হোম ইন্সপেকশন এ একাধিকবার বিক্রেতার সাথে আলোচনা করুন

যে বাড়িটি আপনি কিনতে চাইছেন, সে বাড়ি তৈরির জন্য ব্যবহৃত নির্মাণ সামগ্রী যাচাই বাছাই করা খুবই জরুরীজিজ্ঞেস করে নিন বাড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত সিমেন্টের কোয়ালিটি, রডের গ্রেড কেমন ছিলো। প্রয়োজনে হোম ইন্সপেকশন এ একাধিকবার বিক্রেতার সাথে এসব নিয়ে আলোচনা করুন। 

বিল্ডিং কোডঃ

আপনি যে বাড়িটি পছন্দ করেছেন সেটির নির্মাণ-ফাউন্ডেশেনের বিস্তারিত জেনে নিতে ভুলবেন না। বিশেষত বিল্ডিং কোডের বিষয়টি জেনে নেয়া খুব প্রয়োজনীয়। বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি ভবন আপনাকে ভূমিকম্পের সময় বড় ধরনের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করবে। শুধু তাই নয়, বিল্ডিং হেলে যাওয়া বা ধ্বসে পড়ার মতো দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পেতে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরি করতেই হবে। আপনার পছন্দের বাড়িটি যথার্থ বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি কিনা সেটি জানতে ‘অকুপেন্সি সার্টিফিকেট’ দেখে নিন। 

বাড়ি কেনার আগে ভাবতে হয় অনেক কিছুই। আমরা সবাই জানি বাড়িটি ঘুরে দেখতে হবে, জানতে হবে এর আর্থিক দিকগুলো ও বিভিন্ন আইনি ধাপ। তবে সবচেয়ে প্রথমে বাড়িটি দেখার সময় যদি উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো খেয়াল না করেন তবে ভবিষ্যতে ভোগান্তিতে পড়তে হবে আপনাকেই। তাই নিজে উপস্থিত থেকে এগুলো দেখে নিন, হোম ইন্সপেকশন এ প্রয়োজনে ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি, প্লাম্বিং মিস্ত্রিদের সাহায্য নিন। তাতে কিছুটা সময় ও অর্থ ব্যয় হবে ঠিকই, তবে আপনার ভবিষ্যত বাড়িটি হবে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও ঝামেলাবিহীন।  

Write A Comment