মাথা গোঁজার ঠাই কিংবা আবাসস্থল যা ই বলি না কেন, এশহরের বেশিরভাগ মানুষ বসবাসের জন্য ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনতেই বেশি স্বস্তি বোধ করেন। এই স্বস্তির কারন হল, ফ্ল্যাট কেনার জন্য আলাদা করে জমি কেনা বা বাড়ি নির্মাণের ঝামেলা নেই। বর্তমানে এই ফ্ল্যাট গুলো নির্মাণ ও বিক্রির জন্য রয়েছে অসংখ্য বিভিন্ন আবাসন প্রতিষ্ঠান বা ডেভেলপার কোম্পানি। যাদের কাছ থেকে অনেকেই সরাসরি ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবেন এবং কেনেনও। তবে এই আবাসন প্রতিষ্ঠান বা ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ফ্ল্যাট কেনার আগে ডকুমেন্ট যাচাই করে নেওয়া প্রয়োজন, বিশেষত চুক্তিপত্র। চুক্তিপত্রের কোন বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে? এছাড়াও কোথায় কোথায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে? এই সব প্রশ্নের সহজ উত্তর উঠে আসবে আজকের লেখায়।
কোম্পানি সম্পর্কে খোঁজ নিন
ফ্ল্যাট কেনার আগে ডকুমেন্ট যাচাই এর সময় ডেভেলপার কোম্পানিটি সম্পর্কে ভালভাবে খোঁঁজ নিন। যে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি কিনতে যাচ্ছেন তার মালিকানা আছে কি না, সে বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে নিন। এ জন্য আপনার পছন্দের ফ্ল্যাটটি যে জমিতে অবস্থিত, তার সর্বশেষ রেকর্ডে বিক্রেতার নাম উল্লেখ আছে কি না এবং সিএস, আরএসসহ অন্যান্য খতিয়ান ঠিক আছে কিনা মিলিয়ে নিন। এছাড়া, কোম্পানিটির সরকারি অনুমোদন আছে কি না, রাজউক কর্তৃক অনুমোদিত প্ল্যান আছে কি না, কোম্পানিটি রিহ্যাবের সদস্য কি না এসব তথ্য খতিয়ে দেখুন। কেনার আগে আপনার এটুকু সতর্কতা অবলম্বন করতে পারলেই আপনি খুঁজে নিতে পারবেন ফ্ল্যাট কেনার জন্য সঠিক ডেভেলপার ।
আইনি সহায়তায় চুক্তি করুন
একজন ক্রেতা হিসেবে আইনি সহায়তায় চুক্তি করুন। কীভাবে ফ্ল্যাট কিনছেন, শর্তগুলো চুক্তিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে কিনা দেখুন। ভবন নির্মাণে যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হবে তাও এই চুক্তিতে উল্লেখ থাকা জরুরি। ফ্ল্যাটের অনুমোদিত নকশাও একজন ক্রেতা হিসেবে আপনাকে দেখাতে এবং দিতে বাধ্য ডেভেলপার কোম্পানি। তাই নকশাটি নিজ থেকে চেয়ে নিন এবং যাচাই করুন। ভবনের কোন ফ্ল্যাটটি কিনছেন তা চুক্তিতে উল্লেখ করুন। আপনার বিনা অনুমতিতে ফ্ল্যাটটি পরিবর্তন করা যাবে না, সেটি চুক্তিতে বলে রাখুন। শর্তের বাইরে অতিরিক্ত কোনো অর্থ দিতে ক্রেতা হিসেবে আপনি বাধ্য নন, তা–ও চুক্তিতে উল্লেখ করুন। রিয়েল এস্টেট আইন অনুযায়ী একজন ক্রেতা তাঁর সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধের ৩ মাসের মধ্যেই আবাসন নির্মাতা ফ্ল্যাটের দখল হস্তান্তর, দলিল সম্পাদন এবং নিবন্ধনের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করে দিতে বাধ্য। এই হস্তান্তরের সময় ফ্ল্যাটের আয়তন যদি কমবেশি হয়, তাহলে তার দামও চুক্তি অনুযায়ী সমন্বয় করে নিতে হবে। এছাড়া যদি ডেভেলপার কোম্পানি নির্দিষ্ট সময়ে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করতে ব্যর্থ হয় তাহলে চুক্তিতে নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের অর্থ ক্রেতা হিসেবে আপনি দাবি করতে পারবেন। চুক্তি করার সময় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উল্লেখ আছে কিনা এবং আপনার স্বার্থ তাতে সংরক্ষিত হচ্ছে কিনা এ সব কিছু দেখে নিন। সব কিছু চুক্তিপত্রে ঠিকভাবে উল্লেখ থাকার পরেও বারবার চুক্তিপত্রটি পড়ে দেখুন কোথাও কোন ফাঁক থেকে গেল কিনা। অনেক সময় চুক্তিপত্রে এমন কিছু শর্ত লেখা থাকে, যা ঠিকভাবে দেখে না নিলে পরবর্তীতে ঝামেলা হতে পারে যা আপনার আইনি সহায়তার সুযোগ নষ্ট করতে পারে। এজন্য এই চুক্তিপত্রটি বারবার পড়ুন এবং অবশ্যই আপনার পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য আইনজীবীকে দিয়ে দেখিয়ে নিন। ফ্ল্যাট কেনার আগে ডকুমেন্ট যাচাই এর এই ধাপগুলোই কিন্তু রিয়েল এস্টেট সেক্টরে আপনার প্রতারিত হবার ঝুঁকি অনেকখানি কমিয়ে দেবে।
আরও কিছু বাড়তি সতর্কতা
ফ্ল্যাট কেনার আগে ডকুমেন্ট যাচাই এর ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, জমির মালিকেরা ঝামেলাযুক্ত জমি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানে দিয়ে থাকেন। ফলে ডেভেলপার কোম্পানির কাছ থেকে ফ্ল্যাট বুঝে পেলেও, ভবিষ্যতে এ নিয়ে আইনি ঝামেলা পোহাতে হতে পারে। তাই, জমির মালিকের সঙ্গে ডেভেলপারের আমমোক্তারনামা ও যে যে চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয়েছে, তা ভালোভাবে যাচাই করে নিন। অনেক সময় দেখা যায়, রাজউক ৪/৫ তলার অনুমোদন দিলেও ডেভেলপার কোম্পানি ৮/১০ তলার ভবন নির্মাণ করেন। এ ধরনের সমস্যাযুক্ত প্রপার্টি অবশ্যই এড়িয়ে চলুন। রাজউক আসলে কততলাবিশষ্ট ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে এই বিষয়গুলোও আপনি নিজে খতিয়ে দেখুন। প্রয়োজনে পার্শ্ববর্তী ভূমিমালিকদের কাছ থেকে দাগ-খতিয়ান জেনে মেলাতে হবে। হাল খাজনা সঠিক আছে কি না, মিলিয়ে দেখুন। এছাড়াও, বিদ্যুৎ-সংযোগ আছে কি না এবং তা থাকলে এ বিদ্যুৎ বিল কি বাণিজ্যিক না আবাসিক, ডকুমেন্ট দেখে এসবকিছু যাচাই করে নিন। গ্যাস-সংযোগ নেওয়ার কথা থাকলে তা আইনগতভাবে নেওয়া হয়েছে কি না ডকুমেন্টে দেখে নিন।
কখন আইনের সাহায্য নেবেন
আপনার চুক্তিপত্রটিই কিন্তু আইনের সাহায্য নেয়ার জন্য আপনার শক্তিশালী হাতিয়ার। চুক্তি অনুযায়ী আপনার বুকিং দেওয়া ফ্ল্যাটটি সময়মতো না হলে অথবা চুক্তিতে নির্ধারিত নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার না করলে কিংবা নকশা পরিবর্তনসহ অন্য কোনো বিষয়ে জটিলতা তৈরি হলে আপনি আইনের সাহায্য নিতে পারেন। নিজেদের মধ্যে সমাধান না হলে বিষয়টি সালিস আইন ২০০১ অনুযায়ী সালিশি ট্রাইব্যুনালে যেতে হবে। তখন সালিশি ট্রাইব্যুনাল বিষয়টি নিষ্পত্তি করবে। এই আইনের বিধিবিধান লঙ্ঘন করলে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড কিংবা উভয় কারাদণ্ড হতে পারে। তাই ফ্ল্যাট কেনার সময় উপরিউক্ত বিষয়গুলো উল্লেখ করে চুক্তিতে সই করুন। একবার চুক্তি হয়ে গেলে তা থেকে বের হওয়া বেশ ঝামেলার। তাই ভালোভাবে জেনে–বুঝে তবেই ফ্ল্যাটের বুকিং দিন।
সারাজীবনের সঞ্চয় থেকে যে ফ্ল্যাটটি আপনি কিনতে যাচ্ছেন তা হয়তো আপনার সারাজীবনের আকাঙ্খিত স্বপ্ন। তবে, সামান্য তাড়াহুড়ো বা অসতর্কতা এই স্বপ্নপূরণের পথে হয়ে উঠতে পারে বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা। তাই ফ্ল্যাট কেনার আগে ডকুমেন্ট যাচাই করে এবং প্রতিটি বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তবেই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করুন। একজন সম্ভাব্য ফ্ল্যাট ক্রেতা হিসেবে এই লেখাটি আপনার কাছে কেমন লাগলো জানিয়ে দিন কমেন্টে।