Reading Time: 4 minutes

নাম অনেক অর্থবহ একটি বিষয়। আর কোন এলাকার ক্ষেত্রে তো তা আরও বেশি। বিশ্বের অনেক শহরের নামকরণের উৎসই বেশ চমকপ্রদ! অনেক সময় এলাকার নাম শুনেই সেই এলাকা সম্পর্কে অনেক কিছু ধারণা করে নেয়া যায়। তাই আমাদের আজকের লেখা কয়েকটি এলাকার নামের উৎসের খোঁজে।
ঢাকা শতবছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি নগর। সেন, তুর্কী, মোগল থেকে শুরু করে ইংরেজ, কালের বিবর্তনে সকলের অবস্থানের সাক্ষী হয়েছে ঢাকার মাটি। এজন্যই, খুঁজলে দেখা যাবে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নামগুলোর পেছনের ইতিহাসও বেশ চমকপ্রদ!
ঢাকার কোন এলাকার নাম কীভাবে এল, সেই খোঁজেই নেমেছি আমরা। কয়েকটি ঢাকাই এলাকার নামের উৎস বের করার চেষ্টা করব এই ব্লগে। চেষ্টা করব ঢাকার কয়েকটি এলাকার নামকরণের পেছনের কাহিনী তুলে ধরতে।  

শাহবাগ

 ১৭শতকের  বাগ-ই-বাদশাহী

আজকের শাহবাগ

শাহবাগ
শাহবাগে একসময় ছিল বাদশাহী বাগান

শাহবাগ, হাজারো মানুষের পদচারনায় ব্যস্ত এক নাম, আজকের ঢাকার প্রাণকেন্দ্র। অথচ একসময় ঢাকার শেষ সীমানা ছিল এই এলাকা। ১৭ শতকে ঢাকা হয় মোগল বাংলা প্রদেশের রাজধানী আর সেই সাথে হয় শাহবাগের গোড়াপত্তন। হঠাৎ করেই অন্যরকম গুরুত্ব পাওয়া এই এলাকা জুড়ে গড়ে উঠতে থাকে দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন স্থাপনা। সেই সাথে মোগল শাসকদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে এখানে গড়ে উঠে বিশাল ফুলের বাগান যার নাম ছিল “বাগ-ই-বাদশাহী”, ফার্সি ভাষার শব্দটির অর্থ করলে দাঁড়ায় – রাজার বাগান!
আর রাজার বাগান বা বাগ-ই-বাদশাহী থেকেই আজকের শাহবাগ। মোগল শাসনের সমাপ্তির পরে ব্রিটিশ শাসক বা স্থানীয় প্রভাবশালীদের চেষ্টায় কিছুদিন টিকে থাকলেও ধীরে ধীরে এই বাদশাহী বাগান বিলুপ্ত হয়ে যায়। মানুষের মুখে শুধু থেকে যায় নামটি। কে জানে, একসময়ের জৌলুস মনে করিয়ে দিতেই যেন আজ শাহবাগে গড়ে উঠেছে বিশাল ফুলের বাজার!

সাত মসজিদ রোড

সাতটি মসজিদ নয়, সাতটি গম্বুজ!

সাত মসজিদ রোড
সাত মসজিদ রোডের নাম এসেছে সাত গম্বুজ মসজিদ থেকে

মোহাম্মদপুর আর ধানমন্ডির একটি সংযোগ সড়ক হল সাত মসজিদ রোড। নাম শুনে মনে হতে পারে, তবে কি এই রাস্তায় ৭টি মসজিদ আছে? তা হয়ত নেই তবে যে মসজিদের নামে এই রাস্তার নামকরণ তাতে আছে ৭টি গম্বুজ। বলা হচ্ছে মোহাম্মদপুরে থাকা ঐতিহ্যবাহী সাত গম্বুজ মসজিদের কথা। ১৬৮০ সালে, শায়েস্তা খাঁর আমলে  নির্মিত এই মসজিদের নামেই হয়েছে সংলগ্ন সাত মসজিদ রোড-এর নামকরণ, প্রচলিত ধারণা এটিই। 

গেন্ডারিয়া

গেন্ডারিয়া

What a GRAND AREA!

গেন্ডারিয়া
গেন্ডারিয়া নামের ইতিহাসও বেশ চমকপ্রদ

যদি প্রশ্ন করা হয় ঢাকার প্রথম আবাসিক এলাকা কোনটি? উত্তর দিতে হিমশিম খেতে হতে পারে যে কারো। হালের ঢাকায় এখন আছে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী বা উত্তরার মত নামীদামী আবাসিক এলাকা। কিন্তু পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়াকে দেখে আঁচ করার তেমন কোন উপায়ই নেই যে, এটিই ছিল ঢাকার প্রথম আবাসিক এলাকা!
বৃটিশ শাসিত বাংলায়, ঢাকার প্রথম আবাসিক এলাকা হিসাবে গড়ে উঠে গেন্ডারিয়া। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এটি পরিণত হয়েছিল মধ্যশ্রেণির আবাসিক এলাকা হিসেবে। এত পুরাতন এলাকা হওয়ায় বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই গেন্ডারিয়া। কিন্তু কীভাবে এল এই নাম? এ নিয়ে দুটো প্রধান মতামত পাওয়া যায়।

অনেকে বলেন, কোন এক ইংরেজ পরিব্রাজক ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে ঘুরতে গেন্ডারিয়ার লোহারপুলের পাদদেশে এসে পড়েন। এই এলাকার চারপাশের দৃশ্য দেখে এতই বিমোহিত হয়েছিলেন যে তিনি বলে ওঠেন, ‘Wow! What a grand Area!’ সেই থেকেই এই আবাসিক এলাকার নাম হয়ে উঠে ‘গেন্ডারিয়া’।

আর ভিন্নমতটিও বেশ মজার। আখ বা ইক্ষু অঞ্চলভেদে “গেন্ডারি” নামে পরিচিত। তৎকালীন সময়ে দয়াগঞ্জ, মীরহাজিরবাগ এলাকায় প্রচুর গেন্ডারি বা আখের চাষ হতো। সেই আখ বিক্রির জন্যও বিখ্যাত ছিল এই এলাকা। আর সেই থেকে এই এলাকার নাম হয়ে গেন্ডারিয়া।

গেন্ডারিয়ার এই নামকরণের ইতিহাস কি আপনার জানা ছিল? 

ধানমন্ডি 

ধানমন্ডি

পাকা ধানের মণ্ডন কিংবা ফারসি বাজার!

ধানমন্ডি
কে বলবে এই কিছুদিন আগেও ধানমন্ডি ছিল ফাঁকা একটি এলাকা?

রাজায় রাজায় যুদ্ধ, উলুখাগড়ার প্রাণান্ত!” – প্রবাদটির অর্থ অনেকে জানলেও যদি বলা হয়, এই এক শতাব্দী আগেই ধানমন্ডি ছিল উলুখাগড়া আর ছন গাছের রাজ্য, এখানে দেখা যেত দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত আর কালেভাদ্রে দু’একজন মানুষ, তা কজন বিশ্বাস করবেন? অথবা ব্রিটিশ আমলে এখানে বসত ধানের বিশাল বাজার, তাই বা কতটুকু বিশ্বাস হয়?
অথচ, যতদূর জানা যায়, এর সবই আসলে সত্য। ঢাকার আরও বেশ কিছু এলাকার মত ধানমন্ডিতেও লোকালয় গড়ে উঠতে শুরু করে সাতচল্লিশে দেশভাগের পরপর। এর আগে এই এলাকা ছিল সবুজে শ্যামলে ভরা এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল। চল্লিশের দশকেও ধানমন্ডিতে কৃষিকাজ করা হত পুরোদমে আর সম্পূর্ণ এলাকা ছিল ছন এবং উলুখাগড়ায় রাজ্য৷ তাই ধানমন্ডি নামকরণের সাথেও জড়িয়ে আছে এই বিষয়গুলোই।

বাংলা ভাষায় “মণ্ডন” শব্দটির অর্থ সাজসজ্জা বা অলংকার। পুরো এলাকা যখন সোনালী পাকা ধানে ছেয়ে যেত, তখন একে দেখতে লাগত অসাধারণ। মনে হত যেন সোনালী অলংকারের চাদর দিয়ে কেউ এলাকাটিকে ঢেকে দিয়েছে। অনেকের মতে ধানের এই মণ্ডন থেকেই এলাকার নাম হয় ধানমন্ডি।
আবার, ফারসি পরিভাষায় “মন্ডি” শব্দটির অর্থ হাট বা বাজার। আশেপাশে প্রচুর ধান উৎপাদন হওয়ায় ব্রিটিশ আমলে এখানে বসত ধানের বিশাল বাজার। সেই থেকে এই এলাকার নাম ধানমন্ডি হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন।

তাই বলাই যায় যে, ধানমন্ডি নামটির সাথে আমাদের প্রধান খাবার ধান জড়িয়ে আছে। অথচ আজ এই এলাকাকে বলবে এই এলাকায় একসময় ছিল রমরমা ধানের বাজার?

আপনি কি জানতেন ধানমন্ডির নামকরণের পেছনের এই ইতিহাস? অথবা আপনার কাছে কি এই দুটো ব্যাখ্যার বাইরে আরও কোন ব্যাখ্যা আছে ধানমন্ডির নামকরণ নিয়ে? কমেন্টে জানিয়ে দিন আমাদের। আর ঢাকাই নামের ইতিকথা নিয়ে দ্বিতীয় কিস্তি আসছে খুব শীঘ্রই। সেখানে আমরা জানবো ফার্মগেট, আসাদগেট, পিলখানা, হাতিরঝিলসহ আরও বেশকিছু এলাকার নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে। পড়তে হলে চোখ রাখুন বিপ্রপার্টি ব্লগে

Write A Comment