Reading Time: 6 minutes

কথায় বলে, বইপড়ুয়াদের ভিন্ন এক জগৎ থাকে । সেই জগতে তাদের সঙ্গী শ্রীকান্ত, তারা ঘুরে বেড়ায় অ্যানে কারেনিনার সাথে ট্রেনে, অ্যাডভেঞ্চার করে হাতকাটা রবিনের সাথে, হেঁটে যায় বেকার স্ট্রিটের রাস্তায়। আজ যেসব কাল্পনিক বাসা-বাড়ি গুলোর কথা বলছি, সেসবও বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা ভিন্ন জগতের বাসা-বাড়ি। এগুলোর কোনোটি হয়তো আমাদের কল্পনা করতে শিখিয়েছে কেমন হবে গাছের ওপর বসতবাড়ি, কোনোটি হয়তো নিয়ে গিয়েছে নব্বইয়ের দশকের একতলা বাড়িগুলোয়। কোনোটি বলেছে কেমন হয় ওল্ড ইংল্যান্ডের ম্যানসন, কোনোটি আবার জানিয়েছে কলকাতার বাঙালি গৃহের কথা। বইয়ের পাতায় পাওয়া কাল্পনিক বাসা-বাড়ি গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বাড়ি নিয়ে লিখছি এই ব্লগ!

 

শ্রীপুর জমিদার বাড়ি (বউ ঠাকুরানীর হাট)

শ্রীপুর জমিদার বাড়ি
সুরমার পৈতৃক ভিটা শ্রীপুর জমিদার বাড়ি

‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনন্য এক সৃষ্টি। এ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র সুরমা। সুরমার পৈতৃক ভিটা শ্রীপুর জমিদার বাড়ি। এ বাড়ির আঙ্গিনায় তার বেড়ে ওঠা। এ বাড়ির আভিজাত্য তার মার্জিত আচরণে সুস্পষ্ট। লাল ইটে গড়া এ জমিদার বাড়িটির রয়েছে বিশালাকার ছাদ, সুবৃহৎ দরজা ও জানালা। ব্রিটিশ আমলের জমিদার বাড়ির নকশার ছাপ এ জমিদার বাড়ির বর্ণনায় পরিলক্ষিত হয়।

তবে অন্যান্য কাল্পনিক বাসা-বাড়ি থেকে একে আলাদা করেছে বইয়ের পাতার বাইরেও এর উপস্থিতি। বউ ঠাকুরানীর হাত মূলত ইতিহাস আশ্রিত কাল্পনিক উপন্যাস। ফলে এর স্থান ও পাত্র-পাত্রীরা মূলত বাস্তব। ধারণা করা হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র সুরমার স্মৃতিজড়িত মাগুরার শ্রীপুরের জমিদার বাড়িটির অবস্থান সত্যিই শ্রীপুরে। এটি এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ। তবে স্থানীয়রা এর সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবি জানান। 

স্থানীয় শিক্ষাবিদ ও ইতিহাস গবেষকদের দেওয়া তথ্য মতে, পনেরশ’ শতাব্দিতে নবাব আলী বর্দী খাঁর কাছ থেকে এ অঞ্চলের জমিদারি কিনে নেন সারদা রঞ্জন পাল। যশোরের প্রভাবশালী রাজা প্রতাপাদিত্য তার ছেলে উদয়াদিত্যের সঙ্গে বিয়ে হয় শ্রীপুরের জমিদার সারদা রঞ্জন পালের কন্যা বিভা রানী পালের। প্রতাপাদিত্যের সহযোগিতায় সারদা রঞ্জন নির্মাণ করেন এই জমিদার বাড়ি। প্রতাপাদিত্য ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজা,আর সারদা রঞ্জন তার তুলনায় উদার মনের মানুষ। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি হয়,এর প্রভাব পড়ে সারদার মেয়ে বিভা পালের সংসারে। পরবর্তীতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ কাহিনীকে উপজীব্য করে রচনা করেন ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ নামে একটি উপন্যাস, যা পাঠকের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।

নিরিবিলি (বহুব্রীহি)

পুরোনো বাড়ি
দোতলা বাড়ির সামনের অংশে একটি বারান্দা আছে, সেই বারান্দায় আছে বসার ব্যবস্থাও

“উঁচু দেয়ালে ঘেরা পুরানো ধরণের বিশাল দোতলা বাড়ি।” …………বাড়ির নাম নিরিবিলি, শ্বেত পাথরে গেটের উপর নাম লেখা, অবশ্যি ‘র’ এর ফোটা মুছে গেছে। পাড়ার কোন দুষ্ট ছেলে হারিয়ে যাওয়া ফোটাটা বসিয়ে দিয়েছে ‘ব’ এর উপর। এখন বাড়ির নাম ‘নিবিরিলি’।”

উপন্যাসের একেবারে শুরুর অংশ এটি। ফলে পাঠকের মনে দেয়ালে ঘেরা পুরোনো দোতলা বাড়ির ছবি আঁকা হয়ে যায় সহজেই। এ বাড়ির একতলার বাসিন্দাদের একজন হলেন বাবা সোবাহান সাহেব, যিনি বারান্দায় বসে প্রায়ই বই বা খবরের কাগজ পড়েন। তাই ধারণা করা যায়, দোতলা বাড়ির সামনের অংশে একটি বারান্দা আছে, সেই বারান্দায় আছে বসার ব্যবস্থাও। এ বাড়িতে আরো আছেন সোবহান সাহেবের স্ত্রী মিনু, তার ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া কন্যা মিলি, শ্যালক ফরিদ, ঘরের কাজে সাহায্যকারী কাদের ও রহিমার মা। ধরে নেয়া যায়, বাড়িতে একটি ঘর সোবহান সাহেব ও তার স্ত্রীর জন্য, আরেকটি ঘরে থাকে মিলি। অন্য আরেকটি ঘরে কাদেরের বাস করার কথাও ধারনা করা যায়। উপন্যাসের এক পর্যায়ে পরিবারের বড় মেয়ে বিলুর আবির্ভাব ঘটে। সে ময়মনসিংহ মেডিকেলে পড়ে বলে বাড়িতে থাকে না। তার আলাদা ঘর ছিলো কিনা এ সম্পর্কে কিছু এ উপন্যাস থেকে ধারণা করা যায়না। তবে অতিথি হিসেবে এমদাদ হোসেন ও তার নাতনি পুতুল আসলে তাদেরকে আলাদা ঘর দেয়া হয়েছে, ফলে আরো একটি কক্ষের কথাও অনুমান করা যায়। 

নিরিবিলি নামের এ বাড়িতে একটি বসার ঘর ও খাবার ঘরও রয়েছে। ডাক্তার মনসুর যখন এ বাড়িতে এসেছেন, সে ঘটনার বর্ণনায় ও রাতের খাবারের বর্ণনায় এই দুটো ঘরের কথা এসেছে। শুধু তাই নয়, নিরিবিলিকে আরো অনন্য করে তুলেছে এর ছাদ ও চিলেকোঠা। ছাদে আছে শখে ও যত্নে বেড়ে ওঠা ফুলের গাছ, যা দেখতে বিলুর মতো মমতাময়ী প্রায়ই ছাদে যান। আর চিলেকোঠায় যে একটি ঘর আছে তা জানা যায় আনিস ও তার ছেলেমেয়েদের আবির্ভাবের পর। সেই ঘরেই আনিস, টগর ও নিশা সংসার পাতে। সেখানেই তাদের শোবার খাট ও রান্নার আয়োজন। দোতলা এই বাড়িটি মূলত নব্বইয়ের দশকের বাড়িগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। কাল্পনিক বাসা-বাড়ি হলেও এখানে অতিথি-পরিজনের মিলনমেলা বসে দারুণ আন্তরিকতায়। 

উদ্বাস্তুদের আশ্রয় (একটি তুলসী গাছের কাহিনী)

পুরোনো বাড়ি
উপন্যাসটির প্রধান চরিত্রই এ বাড়িটি, যা মূলত নীলকুঠি দালানের নকশায় তৈরি

“দোতলা, উঁচু এবং প্রকান্ড বাড়ি।” এভাবেই এই উপন্যাসে বাড়িটির বর্ণনা দিয়েছেন প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। বাড়িটি ঠিক রাস্তার ধারেই। উপন্যাসে সরাসরিই বলা হয়েছে, এর উঠান প্রশস্ত। পেছনে আম-কাঁঠাল গাছে ভরা অন্ধকারচ্ছন্ন জায়গা, যা দেখে উপন্যাসের চরিত্র মতিনের মনে বাগান করার শখ জাগে। এ বাড়িটির যে দোতলা আছে সে কথাও উপন্যাসে ফুটে ওঠে, কেননা দোতলার সিঁড়ি ভেঙে ওঠার বর্ণনাও পাওয়া যায়।

উপন্যাসটির প্রধান চরিত্রই এ বাড়িটি, যা মূলত নীলকুঠি দালানের নকশায় তৈরি। বড় বড় জানালাওয়ালা অনেকগুলো ঘরের এই বাড়িটির বাসিন্দারা মূলত উদ্বাস্তু। দেশভাগের পর বাড়ির মালিক এ বাড়ি ফেলে চলে গেছে সীমানার ওপারে। আর সদ্য এ দেশে প্রবেশ করা বাঙ্গালিরা দখল করে নিয়েছে বাড়িটি। ঠিক দখল করার লক্ষ্যে দখল করেনি তারা, করেছে বাধ্য হয়ে। কেননা ওপার থেকে পালিয়ে আসা এ লোকগুলোরও যাবার কোনো জায়গা নেই।

শুরুতে এই বাড়ির বর্ণনা পড়তে বেশ ভালো লাগে, ভালো লাগে উদ্বাস্তুদের জমে ওঠা জীবনযাত্রায় এ বাড়ির  মিশে যাওয়ার কাহিনী। তবে পরবর্তীতে বাড়ির আঙ্গিনায় আবিষ্কৃত হয় একটি তুলসীগাছ, যা প্রতিনিধিত্ব করে বাড়ির আদি মালিকের ধর্মের। এরপর ঘটনাচক্রে বাড়িটির কী হয় তা জানতে পড়তে হবে উপন্যাসটি, তবে কাল্পনিক বাসা-বাড়ি নিয়ে করা তালিকায় এটি থাকবে অবশ্যই। 

২১ নম্বর রজনী সেন রোড (ফেলুদা)

পুরোনো বাড়ি
ফেলুদার ভক্তদের কাছে এ কাল্পনিক বাড়ির জনপ্রিয়তা অনেক

সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট অনবদ্য চরিত্র ফেলুদার বাড়ির ঠিকানা এটি। এটি কয়তলা বা এতে কয়টি ঘর তা অনুমান করা ভীষণ মুশকিল। তবু ফেলুদার ভক্তদের কাছে এ কাল্পনিক বাড়ির জনপ্রিয়তা অনেক।

ধারণা করা যায়, এতে আছে একটি বসার ঘর, যেখানে ফেলুদা-তোপসে-জটায়ু নিয়মিত আড্ডা দেয়, যেখানে ফেলুদার ক্লায়েন্টদের সাথে আলোচনা করেন। বাড়িটি মূলত ফেলুদার কাকার। এখানে কাকার পরিবারের সাথে শৈশব থেকেই থাকেন ফেলুদা। বাড়িতে কাকার পরিবারের সদস্য কাকা, তার স্ত্রী ও কিশোর পুত্র তোপসের বসবাসের কথা জানা যায়। আছে চাকর শ্রীনাথও। 

এই ঠিকানার বাড়ির বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে ফেলুদাপ্রেমীরা প্রায়ই এর খোঁজে চলে যান রজনী সেন রোডে। তবে ২১ নম্বরে কোনো বাড়ি না থাকায় কেউ কেউ যান ২১-এ’র বাড়িতে, গিয়ে নিরাশই হন বটে কারণ সেখানে ফেলুদার কোনো নিদর্শনই নেই। আবার কেউ যান ২১ বি’র অফিসে, যা মূলত বেসরকারি একটি অফিস। 

২২১বি বেকার স্ট্রিট (শার্লক হোমস)

২২১ বি, বেকার স্ট্রিট। ঠিকানাটা খুব চেনা আমাদের সকলেরই। বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ঠিকানা গুলোর একটি এটি। আর্থার কোনান ডয়েলের লেখায়, ঐ বাড়িতে হোমস আর ওয়াটসন কাটিয়েছেন ১৮৮১ সাল থেকে ১৯০৪, টানা প্রায় ২৫ বছর। ডয়েলের লেখায় আরো জানা যায়, ঐ বাড়িটি একসময় ছিল সরাইখানা। বাড়ির মালিক ছিলেন মিসেস হাডসন। 

ভিক্টোরীয় স্থাপত্যের নিদর্শন বাড়িটির একতলায় মিসেস হাডসনের রেস্তোরাঁ। শার্লক আর ওয়াটসন থাকতেন দোতলায়। দোতলায় একটা ছোট্ট পড়ার ঘর। নীচ থেকে ১৭টি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হতো দোতলায়। ঘরটি যে সত্যি ছোট, তা ড. ওয়াটসনের লেখাতেই এসেছে একাধিকবার। রাস্তার ধারের দুটি জানালা দিয়ে যেটুকু আলো আসতো, তাতেই আলোকিত হতো সেঘর। সেখানেই আসতো শার্লকের ক্লায়েন্ট, জমতো শার্লক-ওয়াটসনের আলোচনা। আর পাশেই হোমসের শোয়ার ঘর। বাড়ির তিনতলায় মিসেস হাডসনের ঘর। তার পাশে, বাড়ির পিছনদিকে ড. ওয়াটসনের শোয়ার ঘর এবং এর ঠিক নীচেই এক চিলতে উঠোন। বইয়ের বর্ণনায় ওল্ড লন্ডনের বেকার স্ট্রিটস্থ বাড়িটিকে কল্পনা করে নেয়া যায় সহজেই। চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখা যায়, ২২১ বি লেখা কালো দরজা আর তার ঠিক ওপরের জানালায় দাঁড়িয়ে ভায়োলিন বাজাচ্ছেন বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমস। 

শার্লকের স্মৃতিরক্ষায় বেকার স্ট্রিটে কিংবদন্তিসম এই গোয়েন্দার স্মৃতি বিজড়িত সংগ্রহশালা চালু হয় ১৯৯০ সালের ২৭ মার্চ। 

গ্যাটসবি ম্যানসন (দি গ্রেট গ্যাটসবি) 

নিউ ইয়র্কের গোল্ড কোস্টের একটি বাড়ি
গ্যাটসবি ম্যানসন বা ইস্ট এগের অনুপ্রেরণা আসলে নিউ ইয়র্কের গোল্ড কোস্টের একটি বাড়ি

বিশ্বখ্যাত বই দি গ্রেট গ্যাটসবি’র ম্যানসনের বর্ণনায় আভিজাত্য ও সম্পদশালীতার প্রমাণ পাওয়া যায় স্পষ্টভাবে। এটি একটি ওয়াটারফ্রন্ট প্রপার্টি, অর্থাৎ এর সামনে বড় জলাশয় ও ফোয়ারা আছে। নরম্যান স্টাইলের প্রাসাদ এটি। অন্তত ১৪-১৫টি কক্ষ, বড় বলরুম, ডাইনিং হল, মার্বেল পাথরের মেঝের কথা বারবার উঠে এসেছে বইতে। বলা হয় ‘ওল্ড ওয়েস্টপোর্টের আভিজাত্য’ কে তুলে ধরে ম্যানসনটি।

অনেকে বলেন, গ্যাটসবি ম্যানসন বা ইস্ট এগের অনুপ্রেরণা আসলে নিউ ইয়র্কের গোল্ড কোস্টের একটি বাড়ি। তবে এ নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। 

কাল্পনিক বাসা-বাড়ি গুলো আমাদের ফেলে আসা শৈশব-কৈশোর বা বইয়ে ডুবে থাকা সুন্দর সময়ের সাথে ভীষণ ভাবে জড়িত। আমরা কেউ কেউ অমন বাড়িতে থাকার কথাও ভাবি। কমেন্টস বক্সে জানিয়ে দিন কেমন লাগলো বইয়ের পাতার কাল্পনিক বাসা-বাড়ি নিয়ে করা আমাদের এই আয়োজন। জানাতে পারেন আপনার প্রিয় কাল্পনিক বাসা-বাড়ির কথাও! 

1 Comment

  1. Jannatul Ferdous

    I wanna make a beautiful Home mingling or taking ideas from the historical ones ❤️

Write A Comment