Reading Time: 4 minutes

এদেশের পুরোটা জুড়ে যে বাণিজ্য, যে লোকালয়, যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এ সবকিছুতে কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি? কে নির্ধারণ করলো আমাদের খাদ্যাভ্যাস? আমাদের জীবিকা কিংবা চিরাচরিত উৎসব? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে ইতিহাস আর ভুগোলের পাঠ থেকে তুলে আনতে হবে একটা অধ্যায়। অধ্যায়ের নাম বাংলাদেশের নদী। বহুকাল ধরে এই নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে আমাদের সভ্যতা, গতি পেয়েছে যাতায়াত, সোনা ধান পেয়েছে ফসলের মাঠ, আর জাতি হিসেবে আমরা পেয়েছি আমাদের স্বকীয়তা। তাই, আজ আমরা জানবো নদীর কথা, জানবো এঁকেবেকে যাওয়া নদীর সোজাসাপ্টা গল্প। গল্পের আলাদা আলাদা খণ্ডে আমরা জানবো নদীর ইতিহাস, এদেশের প্রধান নদ নদী ও যাপিত জীবনে এর প্রভাব সম্পর্কে। 

নদী নিসর্গ 

নদীই বাংলাদেশের নিসর্গ

বলছি নদীর কথা আরও বলছি নদীই বাংলাদেশের নিসর্গ। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে এ দেশজুড়ে বয়ে গেছে প্রায় ৭০০ নদ-নদী, যার মধ্যে ৫৪ টির উৎপত্তি ভারতে ও তিনটির মিয়ানমারে। দেশের প্রায় ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার এলাকা দখল করে রেখেছে এই নদীগুলো। যার মধ্যে দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে, গভীরতায় ও প্রভাবে এগিয়ে আছে প্রধান তিন নদী- পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। বাংলাদেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী পদ্মা। যার আরেক নাম কীর্তিনাশা। ৩৬৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর আদি বসবাস ভারতের গঙ্গা নদীতে। যেখান থেকে প্রধান শাখা হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাছ দিয়ে সে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশের মানচিত্রে। এরপর চাঁদপুরের কাছে এসে মিশেছে মেঘনার সঙ্গে, অতঃপর বঙ্গোপসাগরে। পদ্মার গড় গভীরতা ৯৬৮ ফুট এবং সর্বোচ্চ গভীরতা এক হাজার ৫৭১ ফুট। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রশস্ততম আরেকটি নদী মেঘনা। আসামের লুসাই পাহাড় থেকে জন্ম নেয়া এই নদী প্রিয় জেলা সিলেট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মেঘনার প্রধান শাখা নদীগুলোর একটি  ধলেশ্বরী। এদেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নদী যমুনা। যমুনা ব্রহ্মপুত্রের প্রধান শাখা নদী। ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিল ৭ দশমিক ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যমুনার জন্ম হয়। চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে যমুনা গোয়ালন্দ ঘাটের কাছে মিশেছে পদ্মার সাথে। প্রশস্ততার হিসেবে যমুনাও কম যায় না। বর্ষার সময় তীর থেকে তীরের দূরত্ব দাঁড়ায় প্রায় ৮ থেকে ১৩ কিলোমিটার। যমুনার শাখা নদীগুলোর মধ্যে তিস্তা, ধরলা, করতোয়া ও আত্রাই অন্যতম। আড়িয়াল খাঁ, ভৈরব, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, গড়াই, মধুমতী, কর্ণফুলী। আরো অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ নদী রয়েছে বাংলাদেশে। নদীর কথা বলতে হলে তাই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়  কপোতক্ষ, শীতলক্ষ্যা, কুশিয়ারা, হালদা, কীর্তনখোলা ও তিস্তাসহ মিষ্টি নামের আরো অসংখ্য নদী আর তার শাখা প্রশাখাকে। এসব নদীর কথা বর্ণনা করে লিখে যাওয়া যাবে পাতার পর পাতা। জুড়বে আরেক অধ্যায়। তবে আজকে সে বর্ণনায় না গেলেও, পরবর্তী খণ্ডে আমরা জানবো আমাদের জীবন, জীবিকা ও বেঁচে থাকায় নদীর প্রভাব আসলে কতটুকু সে সব কিছু নিয়ে।    

আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে 

বাংলাদেশের নদী
এখনো  নদ-নদী আমাদের জীবন ও জীবিকায় ভূমিকা রেখে চলেছে

অন্নদামঙ্গল কাব্যের এই বর বা আশীর্বাদ, এদেশের নদ-নদীগুলোই আমাদেরকে দিয়ে যাচ্ছে আবহমান কাল ধরে।  পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এই বাংলাদেশ, যার অধিকাংশ ভূমি গঠিত হয়েছে পলি মাটি দিয়ে। এই ভূমির উর্বরাশক্তি ধরে রাখতেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ভূমিকা রেখেছে এই পলি মাটিই। এদেশের নদীগুলোই ভূমি গঠনের এই পলি বয়ে এনেছে। তাইতো এই ভূমি গঠনের হাজার হাজার বছর পর এখনো এই নদী আমাদের জীবন ও জীবিকায় ভূমিকা রেখে চলেছে, দেবীর সেই আশীর্বাদের মতোই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের দুধে-ভাতে থাকার নিশ্চয়তা। নদীবিধৌত দেশ বলেই সেই আদিকাল থেকে এদেশের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি। সাম্প্রতিক সময়ে এই কৃষিতে যুক্ত হয়েছে আধুনিক উপকরণ। ব্যবস্থা হয়েছে আধুনিক সেচের। গৃহীত হয়েছে বড় বড় প্রকল্প। এবং এই সবকিছুই হয়েছে এবং হচ্ছে নদীকে কেন্দ্র করে। এক সময় বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার ছিল দক্ষিণাঞ্চল। বিশেষ করে বরিশাল অঞ্চল। এক সময় বরিশালকে বলা হতো, ‘ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল‘। প্রবাদটি প্রচলিত ছিল সারা দেশজুড়েই। এই প্রবাদ নদী এবং খালের সঙ্গে ধান উৎপাদনের সম্পর্ককে বুঝিয়ে দিচ্ছে স্পষ্টভাবে। নদীর আরেক দান মাছ। বাংলাদেশে সবচেয়ে সুলভ মাছ ইলিশ৷ বাঙালির ইলিশ নিয়ে, ইলিশের রসনা বিলাস নিয়ে কত গল্প কবিতা হয়েছে, তা কি গুনে শেষ করা যাবে না। সেই ইলিশও এই নদীরই দান। আরও কত মাছ এখানে পাওয়া যায় সেই হিসেব করতে গেলেও হয়তো অংক কষতে হবে দিনের পর দিন।  

নদী ও নগর 

বাংলাদেশে
নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের নগর-বন্দর

নদী এই দেশে জালের মতো ছড়ানো। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সব নগর-বন্দর। একসময় যাতায়াত মানেই ছিল নদীপথ। এদেশের সভ্যতার ইতিহাসও সে কথাই বলছে। নদীপথে যাতায়াত সুবিধা এবং নদী উপত্যকার পলিমাটি আর কৃষিভূমির কারণেই বাংলাদেশের সব শহর-নগর গড়ে উঠেছে নদীর কোল ঘেষে। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে ঢাকা মহানগরী, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জ শহর ও বন্দর, কর্ণফুলি নদীর তীরে চট্টগ্রাম কিংবা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ময়মনসিংহ শহর! বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর রাজশাহীও অবস্থিত পদ্মার উত্তর তীরে। পুরোটাজুড়েই নদী জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্ব। সে অস্তিত্বে এখন খানিক ভাটা পড়লেও নদীর এই অপার দানকেও অস্বীকার করার উপায় নেই।  

যে নদীর পলিতে বাংলাদেশের জন্ম, সেই নদীকেই ঘিরেই এখনো বেঁচে আছে বাংলাদেশ, বেঁচে আছি আমরা। তাই নিজেদের প্রয়োজনেই টিকিয়ে রাখতে হবে নদী ও নদীর কথা। বাধাহীন করতে হবে এর স্বাভাবিক প্রবাহ। নগরকে বিশুদ্ধ রাখতেই বর্জ্যমুক্ত করতে হবে নদীর চারপাশ। থামাতে হবে নদী ভরাট করে জমি দখলের দৌরাত্ম্য। আজকের লেখা পড়ে, নদীর প্রতি এ দায়বদ্ধতা আপনি কতটুকু উপলব্ধি করলেন, জানান কমেন্টে। 

Write A Comment

Author