গত দুই দশকেরও কিছু বেশি সময় হল বাংলাদেশের আবাসন শিল্প ফুলে ফেপে উঠছে। আর আবাসন শিল্পের সাথেই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত স্থাপত্যবিদ্যা। দেশের স্থাপত্য শিল্পে দেখা যাচ্ছে নতুনের ছোঁয়া। দেশের স্থপতি তথা আর্কিটেক্টরা নতুন নতুন ডিজাইন, ম্যাটেরিয়াল বা কৌশল নিয়ে নানান ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে, কোন একটি স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে কীভাবে ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি বিশেষ করে দেশকে ফুটিয়ে তোলা যায়, সে চেষ্টাই তাঁরা করে চলেছেন। আবার স্থপতিরা কল্পনা করেন, আর সে কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেন বিভিন্ন ডেভেলপারেরাই। আর তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই দক্ষিণ এশিয়ার এই জনবহুল এই দেশটিও ধীরে ধীরে আবাসন শিল্পে সম্মানজনক একটি স্থানে যেতে শুরু করেছে।
স্থাপত্যবিদ্যা – একটি কালজয়ী শিল্প
একটি স্থাপনা কোন নির্দিষ্ট সময়ে একটি স্থানে বা দেশে হতে পারে। কিন্তু এর অন্যন্যতা একে স্থান, কাল, পাত্রের গন্ডি ছাড়িয়ে নিয়ে যায় বহুদূর। অর্থ্যাৎ স্থাপত্যশিল্প হল একটি কালজয়ী শিল্প। হোক তা ছোট কোন দালান কিংবা সুউচ্চ, আকাশছোঁয়া অট্টালিকা, নির্মাণশৈলী তাকে দিতে পারে অনন্যতা।
সারা পৃথিবীতে এমন ভুবন-ভুলানো, চোখ জুড়ানো স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন খুঁজলে পাওয়া যাবে অনেক। বাংলাদেশি হিসাবে আমাদের জাতীয় সংসদ ভবনের কথাই ধরা যাক। বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কান-এর নকশায় নির্মিত এই স্থাপনা সত্যিই কালজয়ী এবং অসাধারণ। এই সৃষ্টি বাংলাদেশে হলেও এর সুনাম ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে।
বাংলাদেশের নানান আধুনিক স্থাপত্য নিদর্শন
দেশের স্থপতিরা এখন বিভিন্নভাবে এক্সপেরিমেন্ট করছেন সাস্টেইনেবল তথা দীর্ঘ স্থাপনা নির্মাণের। সাস্টেইনিবিলিটি ছাড়াও কীভাবে আরও উন্নত, আধুনিক স্থাপনা, পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নির্মাণ করা যায় সে চেষ্টাও চলছে। আর এরূপ চেষ্টার ফলেই একে একে তৈরি হচ্ছে এমন সব স্থাপনা যা আগে কখনোই দেখা যায় নি।
বাইতুর রউফ মসজিদ হতে পারে এক চমৎকার উদাহরণ। দেশের সুনামধন্য নারী স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমের নকশা করা এই মসজিদ জিতে নিয়েছে সম্মানজনক “দি আগা খান অ্যাওয়ার্ড”। আধুনিক স্থাপত্য নকশার একটি অনন্য উদাহরণ এটি। মসজিদ বললেই আমাদের মাথার যে মিনার বা গম্বুজের কথা আসে তার কিছুই নেই এই মসজিদে। তারপরেও এর অনন্য নকশার কারণে এটি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে সবার কাছেই। প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে এত সুন্দরভাবে এর ডিজাইন করা যে আলাদা কোন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে না এখানে। তীব্র শীত বা প্রচন্ড গরমেও আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের কিছুই অনুভূত হয় না ভেতর থেকে। যা “গ্রিন বিল্ডিং” বা “গ্রিন আর্কিটেকচারেরও” উদাহরণ।
আর সবুজ নির্মাণ সংক্রান্ত কথা উঠলে সেখানে থাকবে স্থপতি রফিক আজমের নাম। সবুজে ঘেরা নদীমাতৃক বাংলাদেশের কথা মাথায় রেখে করা তাঁর ডিজাইনগুলো শুধু দেশেই না বরং আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত। মেরিনা তাবাসসুম এবং তিনি মিলে নকশা করেছেন স্বাধীনতা স্তম্ভ এবং স্বাধীনতা জাদুঘর। ভূগর্ভস্থ এই স্থাপনা বাংলাদেশের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র জাদুঘর।
এছাড়াও উল্লেখ করা যায় সম্প্রতি আলোড়ন সৃষ্টিকারী চাদপুরের শাহাবুদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কথা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হবার পর দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাটি ইতোমধ্যেই দেশব্যাপী পরিচিত হয়ে উঠেছে। দ্বিতল এই ভবনটি ইউরোপীয় নকশার আদলে তৈরি।
বাংলাদেশের আবাসন খাত – আধুনিক হয়ে উঠছে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারেরাও
সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন ধরণের বাড়িঘর বা প্রপার্টি নির্মাণের পরিমাণ যেমন বেড়েছে, সাথে সাথে এসেছে তাদের নকশায় নতুনত্ব। বাসার ভেতরের ইন্টেরিয়র ডিজাইন, রঙ কিংবা ফার্নিচার যত সহজে পরিবর্তন করা সম্ভব তত সহজে বাসার স্ট্রাকচারাল চেঞ্জ আনা সম্ভব না, মানুষ তা বুঝতে আরম্ভ করেছে। নির্মাণকাজ শুরু করার অনেক আগে থেকেই সম্পূর্ণ নকশা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। আর এসব উপলব্ধির সুযোগ নিয়েই দেশের রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারেরা ধীরে ধীরে তাদের সার্ভিসে যোগ করছেন নানা আধুনিক ধারণা।
বাংলাদেশের প্রথম সারির সব ডেভেলপারই হতে পারে এর উদাহরণ। ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড তাদের নকশায় জায়গা দিচ্ছে বিভিন্ন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম, জানালার বিশেষ ধরণের শেড, বাতাস চলাচর তথা এয়ার সার্কুলেশনের জন্য ছোট ছোট ভেন্টিলেটরের। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় মানুষ এখন নিজেই ঘাটাঘাটি করে অনেক ধরণের নতুন নতুন ডিজাইন বের করতে পারছে। ফলে নতুন একটি বাসার চাহিদাপত্রে এমন নতুন সব নকশা প্রায়শই থাকছে। এজন্যই বিটিআই বাংলাদেশ তাদের গ্রাহকদের জন্য রেখেছে বিভিন্ন প্ল্যান। তাদের স্পেশাল প্ল্যানে একজন গ্রাহক নিজের মনের মত ডিজাইন এবং স্পেসিফিকেশন দিয়ে নিজের বাড়িটি সাজিয়ে নিতে পারবেন। ডম-ইনো ডেভেলপারসও এক্সক্লুসিভ অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স তৈরি করছে ছোট পরিবারের জন্য সবধরনের সুযোগসুবিধাসহ।
থাকার জায়গার কথা মাথায় আসলে মানুষ সাধারণত জটিলতা বিবর্জিত, সবুজে ঘেরা, খোলামেলা কিছুই চায়। সম্ভব হলে সেটি সাজিয়ে নিতে চায় নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে। আর আর্ট গ্যালারী, জাদুঘর বা অফিসের মত স্থাপনা নিয়ে অনেকেরই পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে অমত নেই। একারণেই যত দিন যাচ্ছে দেশে গড়ে উঠছে দৃষ্টি নন্দন সব স্থাপনা। যা বাংলাদেশের আবাসন সমস্যার সমাধানই নয় বরং অবদান রাখছে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে।