Reading Time: 5 minutes

ঢাকাই নাম নিয়ে আগ্রহী আছে সবাই। ঢাকার আছে শত বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস। কীভাবে এল ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নাম তা জানতে চান অনেকেই। আর তেমন একটি উদ্যোগ নিয়েই শুরু হয়েছে “ঢাকাই নামের ইতিকথা” সিরিজটি। প্রথম পর্বে আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি শাহবাগ, সাত মসজিদ রোড, গেন্ডারিয়া এবং ধানমন্ডি এলাকার নাম কীভাবে আসল সেই কথাগুলো
দ্বিতীয় পর্বে আমরা খুঁজে দেখব ফার্মগেট, আসাদগেট, পিলখানা, এলিফ্যান্ট রোড, হাতিরঝিল আর ভূতের গলির নামকরণের পেছনের কাহিনী।  

ফার্মগেট

ফার্মগেট
ফার্মের প্রধান ফটক বা গেট থেকেই এসেছে নামটি

স্যার ফিলিপ হার্টগ ছিলেন একজন রসায়নবিজ্ঞানী এবং শিক্ষাবিদ, জীবনের একটি বিরাট অংশ তিনি শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারের পেছনে ব্যয় করেছিলেন। তৎকালীন বৃটিশ সরকারের অধীনে পাবলিক সার্ভিসে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৩০ সালে নাইটহুড উপাধি পান। আমাদের দেশে স্যার ফিলিপ হার্টগের সবচেয়ে বড় পরিচয় হল, তিনি ছিলেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস-চ্যান্সেলর তথা উপাচার্য

কিন্তু স্যার ফিলিপ হার্টগের নামের সাথে ফার্মগেট কীভাবে আসে? মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিপ্রধান পূর্ব বাংলায় গবাদিপশুসম্পদ, চামড়াশিল্প তথা কৃষি গবেষণার অপার সম্ভাবনার কথা একশ বছর আগেই স্যার ফিলিপ ভেবেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র পাঁচ বছরের কর্মজীবনে অসংখ্য জনকল্যাণমূলক কাজের সাথে জড়িয়ে ছিল স্যার ফিলিপের নাম। সেই সময়ে অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর এই বাংলায় বেকারত্ব দূর করতে ১৯২২ সালে ব্রিটিশ সরকার গঠন করে, ‘ঢাকা টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন কমিটি’ বা ঢাকা কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা কমিটি। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন স্যার ফিলিপ হার্টগ। পর্যায়ক্রমে কৃষি উন্নয়ন, কৃষি ও পশুপালন গবেষণার জন্য একটি ফার্ম বা খামার তৈরি করার উদ্যোগ নেয় সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখানে কৃষি গবেষণার সূচনা করেন হার্টগ। প্রতিষ্ঠিত হয় এগ্রিকালচার ইনস্টিটিউট। সেই ফার্মের প্রধান ফটক বা গেট যে এলাকায় ছিল, সেই এলাকার নামই আজ ফার্মগেট!
তাই আজ ফার্মগেটে জ্যামে বসে থেকে কিংবা ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হবার সময় আপনি যদি স্যার ফিলিপ হার্টগ-এর কথা স্মরণ করেন, ঢাকাই নাম হিসাবে এর কথা ভাবেন, তা বোধহয় খুব একটা ভুল হবে না!

আসাদগেট

আসাদগেট
শহীদ আসাদের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় আসাদগেট

১৯৬৯ সাল, স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন আর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে তখন সারা দেশ উত্তাল। দুর্বার আন্দোলন, মুহুর্মুহু  মিছিল, স্লোগান আর হরতালে তখন পাকিস্তানী অপশাসকদের থরহরিকম্প অবস্থা!
সব দুঃশাসকেরা এমন অবস্থায় যা করে, তাই হল, পুলিশ গুলি চালালো আন্দোলনরত ছাত্রনেতাদের উপর। অনেকের সাথে নিহত হলেন ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদ। স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার মনে করেছিল, দুটো গুলির দাপটে তারা মুছতে পারবে বাঙ্গালীর তেজ। 

কিন্তু হল উল্টোটা, শোকাতুর ও আপ্লুত হয়ে কবি শামসুর রহমান লিখলেন – 

গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের

জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট

উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।

ক্রোধে ফেঁটে পড়ে হেলাল হাফিজ লিখলেন –

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

আর সারাদেশে আইয়ুব খানের নামাঙ্কিত সব জায়গা মুছে ফেলার দায়িত্ব নিল সাধারণ জনগণ। বিভিন্ন পার্ক, রাস্তা, সরণির নাম গেল বদলে, মুছে গেল আইয়ুবের নাম। জাতীয় সংসদ ভবনের ডান পাশ  দিয়ে যে রাস্তাটি মোহাম্মদপুরের দিকে চলে গিয়েছে, তার নাম ছিল আইয়ুব গেট। শহীদ আসাদের স্মৃতিতে এর নাম হয়ে গেল আসাদগেট
আসাদ ঠিক এ জায়গায় শহীদ হন নি। তবে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে জীবন বিসর্জন দেয়ায়, সম্মিলিত ছাত্রজনতা আইয়ুবের নামের বদলে আসাদের নামেই এই জায়গার নাম আসাদগেট নামকরণ করেন। তাইতো এখনো এ জায়গায় দাড়িয়ে থাকা তোরণটি আমাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করায় শহীদ আসাদের মহান আত্মত্যাগের কথা।

পিলখানা

পিলখানা
পিলখানা ছিল হাতিদেরই রাজ্য

মোগল আমল বা ব্রিটিশ পিরিয়ড ছিল রাজা, বাদশাহ, সম্রাট, নওয়াবদের আমল। যুদ্ধ-বিগ্রহ বা যাতায়াত, উভয় কারণেই সে সময়ে হাতির কদর ছিল প্রচুর। মোগল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ পিরিয়ড পর্যন্ত ঢাকার প্রশাসনে “খেদা” নামে একটা বিশেষ বিভাগেরই অস্তিত্ব ছিল। এই খেদা বিভাগের কাজ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বন্য হাতি ধরে এনে পোষ মানানো ও প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করে তোলা। সে সময় হাতি ধরে এনে বা “খেদিয়ে এনে” (তাড়িয়ে এনে) ঢাকার যে স্থানে রাখা হত তার নাম হয়ে গেল পিলখানা। আরবীতে “ফিল” শব্দের অর্থ হাতি। সেখান থেকেই এই হাতিশালা বা পিলখানা নামের উদ্ভব।
সেই ব্রিটিশ, মোগল বা খেদা বিভাগের আজ অস্তিত্ব নেই, হাতিও আজ প্রায় বিপন্ন প্রজাতির প্রাণি। কিন্তু পিলখানার নাম যে সেই পিলখানা হল, তা আজ অব্দি রয়ে গিয়েছে।
পিলখানা থেকে আমাদের এলিফ্যান্ট রোডের দুরত্ব কিন্তু খুব বেশি না। তাই পিলখানা যদি হাতিশালা হয় তাহলে কি এলিফ্যান্ট রোডের সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে? 

এলিফ্যান্ট রোড  

এলিফ্যান্ট রোড
হাতিদের জন্যই ডেডিকেটেড রাস্তা!

আগেই বলা হয়েছে যে মোগল বা বৃটিশ পিরিয়ডে হাতির কদর ছিল অস্বাভাবিক রকমের। “খেদা” নামের আলাদা একটি বিভাগই ছিল হাতি সংক্রান্ত কাজের জন্য বরাদ্দ।  আর হাতি রাখার জায়গা ছিল পিলখানা।
কিন্তু, হাতি চলাচলের জন্য যে আলাদা একটি রাস্তাও ছিল তা কি আপনি জানতেন? পিলখানায় থাকা হাতিগুলোকে চারনের জন্য রমনা অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হত। যে আলাদা রাস্তা দিয়ে মাহুতেরা হাতিগুলোকে চারনের জন্য নিয়ে যেতেন, কালক্রমে সেই রাস্তার ঢাকাই নাম হয়ে গিয়েছে “এলিফ্যান্ট রোড”।

হাতিরঝিল

হাতিরঝিল
হাতিরঝিলে খুঁজে পাওয়া যাবে না কোন হাতি

হাতি চলাচলের রাস্তা ছিল এলিফ্যান্ট রোড আর পোষা হাতিগুলো থাকত পিলখানায়। জল জিনিসটি হাতির অত্যন্ত প্রিয়। তাই গোসল হোক কিংবা জলকেলি, হাতিগুলোকে জলাধারের কাছে নিয়ে যেতেই হত। এখনকার রমনা এলাকাকে হাতি চরানোর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো কেননা রমনার আশেপাশেই তখন ছিল অনেক খাল। যেসব খাল বা জলাশয়ে হাতিগুলোকে নিয়ে আসা হত কালের বিবর্তনে তার নামই হয়েছে হাতিরঝিল। আর এই পিলখানা হয়ে এলিফ্যান্ট রোডের মাঝে কোথাও ছিল একটি কাঠ নির্মিত পুল বা সেতু। সে থেকেই উৎপত্তি আজকের “হাতিরপুল” নামটি।
একটু পেছনে ফিরলেই দেখা যাবে মাত্র কয়েক দশক আগেও হাতিরপুল সংলগ্ন পরিবাগ এলাকায় খালের কোন অভাব ছিল না। মানুষের চাপে আজ সেসব খালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। অস্তিত্ব নেই সেই পুরাতন কাঠ নির্মিত হাতিরপুলেরও। হাতিরঝিল আজ অব্দি টিকে থাকলেও যা একসময় ছিল হাতিদের জন্য বরাদ্দ তা আজ বাহারি পার্ক, ব্রিজ আর আলোর নকশা মিলিয়ে মানুষের মনোরঞ্জনের জায়গা!
কালের বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে শুধু নামগুলো, পিলখানা, হাতিরপুল কিংবা হাতিরঝিল হিসাবে।

ভূতের গলি

ভূতের গলি
ভূতের গলিতে ভূত কোথায়?

হাতিরপুল, হাতিরঝিল বা পিলখানা নিয়ে আমাদের লেখাগুলো দেখে আপনার খুব ইচ্ছে হল সেই স্মৃতিবিজড়িত মেমরি লেন দিয়ে হাঁটবার। যে পিলখানায় ইংরেজ বা মোগলদের সৌর্য্যের প্রতীক হাতিগুলো থাকত, যে এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে তারা হেটে যেত, যে হাতিরঝিলে তারা জলকেলি করত, আপনি চাইলেন সব ঘুরে দেখবেন।
যেই ভাবা সেই কাজ! আপনি ঘুরতে ঘুরতে আশেপাশের সব এলাকা দেখতে শুরু করলেন এবং পেয়ে গেলেন এক আজব রাস্তা, নাম তার “ভূতের গলি”! তবে কী এ রাস্তায় ভূতেদের বসবাস ছিল? বিভিন্ন গল্প উপন্যাসের ভূতগুলি কী এখানে এসে আড্ডা জমাতো? তাদের হাঁও-মাঁও-খাঁও-তে সন্ধ্যা নামলেই আশেপাশের এলাকা হয়ে উঠত প্রকম্পিত?
আপনাকে হতাশ করছি বলে দুঃখিত, তবে ঘটনা একদমই এমন কিছু না! শতভাগ নিশ্চিত হওয়া হয়ত যায় না তবে জনশ্রুতি আছে ইংরেজ আমলে “মিস্টার বুথ” নামের একজন ইংরেজ সাহেব সর্বপ্রথম এ এলাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁর নামানুসারে সবাই এই এলাকাকে “বুথের গলি” বলে ডাকতে শুরু করে। অপভ্রংশ হয়ে সেই বুথ, “ভূত” হয়ে যেতে বেশি সময় নেয় নি! তাই তো আজকের এই চমৎকার নাম – ভূতের গলি!
অনেকটা এমনিভাবেই কিন্তু এসেছিল গেন্ডারিয়া এলাকাটির নাম, কীভাবে? জানতে চাইলে দেখুন এখানে

তো এই ছিল বিভিন্ন এলাকার ঢাকাই নাম নিয়ে তিন পর্বে সমাপ্য সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব। পরবর্তী পর্বে আমরা জানতে চেষ্টা করব মালিবাগ, কাকরাইল, ওয়ারীসহ আরও কয়েকটি এলাকার নাম
নতুন নতুন এসব নামকরণের ইতিহাস জানতে চোখ রাখুন বিপ্রপার্টির ফেসবুক পেজে! একই সাথে, আপনার এলাকার নামের উৎস জানা থাকলে আমাদের সাথে শেয়ার করুন এক্ষুণি। শুধু ঢাকা নয় বরং বিশ্বে আরও বেশকিছু শহরের নামকরণ সম্পর্কে জানতে পড়ে ফেলুন এই লেখাটি। আর লেখা নিয়ে আপনার কোন মন্তব্য থাকলে তা জানাতেও ভুলবেন না যেন!

Write A Comment