বাবার হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে প্রথমবারের মত পরিচয় হল অদ্ভুত এক আয়োজনের সাথে। চলছে হরেক রকম কেনাবেচা আর মানুষের সমাগম। চলছে নাগরদোলার ঘুরে চলা, পুতুল নাচ আর সার্কাস। মাইকে শোনা যাচ্ছে নানা রকম নির্দেশনা। একপাশে রঙিন বেলুন উড়ছে, অন্যপাশে ছোট্ট আমি বেলুনের মত দেখতে গোলাপী রঙের হাওয়াই মিঠাই মুখে পুড়ছি। সেদিনই প্রথম জানলাম, অদ্ভুত এই আয়োজনের নাম মেলা।
আরেকটু বড় হয়ে বুঝতে পারি, মেলা মানে নিতান্তই দুই শব্দের একটি শব্দ আর নামমাত্র উৎসব-আয়োজন নয়। বাংলা আর বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর উৎসবের এক নিখাদ প্রতিচ্ছবি এই মেলা। ষড়ঋতুর এই দেশে হেমন্ত থেকে চৈত্র, কোনো না কোনো অঞ্চলে এইসব লোকজ মেলার সন্ধান পাবেন আপনি। আসলে এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপ জনপদে মেলা কেবলমাত্র একটি উপলক্ষ্য। মেলাকে ঘিরে যে আয়োজন তা বহুধা বিস্তৃত এবং বর্ণাঢ্যতায় ভরা। বিভিন্ন পালা পার্বণকে কেন্দ্র করে বছর জুড়ে প্রায় দশ হাজারেরও বেশি ছোট-বড় গ্রামীণ লোকজ মেলা বসে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। শেকড়ের এসব ঐতিহ্য থেকে আজকের আলাপনে তুলে আনবো বাংলাদেশের জনপ্রিয় কিছু লোকজ মেলা ও তার আদির কথা।
বৈশাখী মেলা
বাঙালিদের সব থেকে জনপ্রিয় ও সার্বজনীন লোকজ মেলা হচ্ছে বৈশাখী মেলা। বাংলা নতুন বছর প্রত্যেক বাঙালির কাছেই এক অন্য রকম আবেগের উৎস। সে আবেগেরই স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে বৈশাখী মেলায়। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই ছোট এবং বড় পরিসরে আয়োজিত হয় বৈশাখী মেলা। তবে এর মধ্যে কুমিল্লা জেলার কান্দিরপাড়ের বৈশাখী মেলা অন্যতম । স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলার মূল আকর্ষণ।
লোক ও কারুশিল্প মেলা
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি আয়োজিত হয় লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব। সোনারগাঁও লোকজ ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন চত্বরে মাসব্যাপী এই মেলা বসে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এ লোকজ মেলায় দেশের বিভিন্ন এলাকার সব রকম লোকজ সংস্কৃতি ও কুটির শিল্প সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হন শিল্পীরা । তবে এ মেলায় অনেকেই যান সোনারগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই জামদানি এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বাহারি নকশার নকশীকাঁথা কিনতে।
বটতলায় বৌমেলা
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে চারশ’ বছরের পুরানো একটি বট গাছকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে পালিত হচ্ছে বউ মেলা। বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় দিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীরা পরিবারের সুখ শান্তি ও সুস্বাস্থ্য কামনা করে এখানকার বট গাছকে পূজা করেন। এ উপলক্ষে পাঁচদিনের মেলাও বসে বট গাছের চারপাশে।
লাঙ্গলবন্দের মেলা
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র নদে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী বা অশোকাষ্টমী তিথিতে পুণ্যস্নানের জন্য সমবেত হন। এ উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী মেলা বসে ব্রহ্মপুত্রের দুই তীরে।
লালন মেলা
কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে মরমী শিল্পী লালন সাঁইয়ের সমাধিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর দুইবার লালন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তার একটি হচ্ছে লালন সাঁইজির তিরোধান তিথি উপলক্ষে এবং অন্যটি দোলপূর্ণিমায় লালন প্রবর্তিত সাধুসঙ্গ উপলক্ষে।
রাস মেলা
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবনের দুবলার চরে প্রতি বছর কার্তিক-অগ্রহায়ণের পূর্ণিমা তিথিতে বসে রাসমেলা। অনেক হিন্দু পুণ্যার্থী আর পর্যটক এ উৎসবে শামিল হতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসেন। এ উপলক্ষে পাঁচ দিনের একটি মেলাও বসে দুবলার চরে। ১৯২৩ সাল থেকে মেলাটি চলে আসছে।
রাশ লীলার মেলা
সিলেট এর মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা কমলগঞ্জ আর আদমপুরে কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় মনিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব রাস লীলা। এ উপলক্ষে তিন দিনের মেলা বসে কমলগঞ্জের মাধবপুর ও আদমপুরের সনাঠাকুর মণ্ডপ এলাকায়।
গুড়পুকুরের মেলা
বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এ মেলাটি ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ভাদ্র মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনসা পূজাকে কেন্দ্র করে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। চলে এক মাসব্যাপি।
পোড়াদহের মেলা
গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়ি এলাকায় ইছামতি নদীর তীরে আড়াইশ বছর ধরে বসে ব্যতিক্রমী এক মেলা। প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার বসে দুই দিনের এ মেলা। এ মেলার মূল আকর্ষণ বড় বড় আকৃতির নানা রকম মাছ।
মধু মেলা
যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়িতে প্রতি বছর বসে সপ্তাহব্যাপী মধু মেলা। বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে হয় এ মেলার আয়োজন করা হয়।
রথের মেলা
সাধারণত বাংলা বছরের আষাঢ় মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথের মেলা বসে। সবচেয়ে বড় রথের মেলা বসে সাভারের ধামরাইয়ে। এছাড়া কুষ্টিয়ার রথখোলার মেলা, রাজশাহীর পুঠিয়ার রথের মেলা, সিলেটের লামাপাড়া রথযাত্রার মেলা উল্লেখযোগ্য।
আরো কিছু বিশেষ মেলা
চট্টগ্রামে জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপি একটি মেলা বসে লালদীঘির পাড়ে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে রয়েছে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী খাসিয়া, মণিপুরি, সাঁওতাল, টিপরা ও গারো সম্প্রদায়ের বাস। প্রতি বছরে চা বাগানগুলোয় ‘ফাগুয়া উৎসব’, টিপরাদের ‘বৈসু উৎসব’ মণিপুরিদের ‘রাস উৎসব’ ও গারোদের ‘ওয়ানগালা উৎসব’ উৎযাপিত হয় জাঁকজমকভাবে।
যেভাবে টিকে আছে বাংলার লোকজ মেলা
মেলা শব্দটির খুব সহজ সংজ্ঞা হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট স্থানে নির্ধারিত সময়ে ধর্মীয় উৎসব বা অন্য কোনো উপলক্ষ্যকে ঘিরে সুলভ মূল্যে বিভিন্ন রকম পণ্যক্রয়-বিক্রয় এর উৎসবমুখর আয়োজন। তবে মেলা নামক এ আয়োজনকে কখনোই একটি নির্ধারিত সংজ্ঞায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কারণ কেবল বিনোদন, আর ক্রয়-বিক্রয় নয়, মেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠান। যা আমাদের বিনোদনধারাকে করেছে উর্বর। বৈশাখে বর্ষবরণকে কেন্দ্র করেই যে বৈশাখী মেলা বসে, সেখানে আমরা কেবল কেনাকাটা করতে যাই না। কেউ যাই আনন্দ উদযাপনে, কেউ যাই দেশীয় সংস্কৃতিকে খুব কাছ থেকে আলিঙ্গন করতে।
এমনকি, নব্বই দশকের হাই স্কুলের স্মৃতি হাতড়ালেও আমরা অনেকেই খুঁজে পাব বৈশাখী মেলাকে ঘিরে হৈ-হুল্লোড়ে ভরপুর দারুণ সব মূহুর্ত। যদিও আধুনিক যুগে মেলার রকমফের অনেক। আবাসন মেলা, বৃক্ষ মেলা, বাণিজ্য মেলা, আয়কর মেলা, ফার্ণিচার মেলা, বইমেলা সহ নানা রকমের মেলার আয়োজন থাকে বাংলাদেশে। তবে, আধুনিক ও নগরকেন্দ্রিক এই মেলাগুলো লোকজ মেলার জৌলুস ও জনপ্রিয়তা কমাতে পারেনি। তাই এখনো বাঙালির জীবনযাত্রায় লোকসংস্কৃতি ও নগর সংস্কৃতিতে মেলা নামক এই লোকজ ঐতিহ্যগুলো টিকে আছে হাজার বছর ধরে।